শুক্রবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

ভ্রমণঃ পরিকুন্ড জলপ্রপাত ।



পরিকুন্ড জলপ্রপাত নামটি অনেকের কাছেই অপরিচিত বলে মনে হতে পারে। আরেকটু পরিষ্কার করে বলছি মৌলভীবাজারের মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের নাম আমরা সবাই কম-বেশি শুনেছি এবং অনেকে এই জায়গায় গিয়েছিও। তবে জানা না থাকায় আমরা অনেকেই মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের পাশেই বনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিস্ময়কর একটি ঝর্নার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি। মাধবকুন্ড জলপ্রপাত থেকে খুব কাছে মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিটের হাটা দূরত্বে পরিকুন্ড জলপ্রপাতটি অবস্থিত। 

১৫০ ফুট উচু খাড়া পাহাড় হতে এই ঝর্নার পানি শো শো শব্দ করে নিচের দিকে পতিত হয়েছে। জল ও পাথরের সংঘর্ষে জলকনাগুলো উড়ে গিয়ে মৃদু কুয়াশার সৃষ্টি করে। অসংখ্য প্রজাতির গাছপালা দ্বারা ঝর্নাটির চারপাশ আচ্ছাদিত হয়ে আছে। এ যেনো সবুজের মহাসমারোহ। সেই সাথে পাখির কিচির-মিচির বনের নিস্তব্ধতাকে জাগিয়ে রাখে সর্বক্ষণ। ঝর্নার অপরূপ দৃশ্য অবলোকন করার জন্য প্রাকৃতিক আসন হিসেবে রয়েছে অসংখ্য পাথর। পাথরের উপর বসে ঝর্নার দিকে চোখ রাখলে মনে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছেন। অনেকে নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে নেমে পড়ের ঝর্নার পানিতে নিজের দেহ-মন-প্রাণ জুড়িয়ে নিতে।

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার মাধবকুন্ড জলপ্রপাত থেকে মাত্র ১০ থেকে ১২ মিনিটের হাটা দূরত্বে এই বুনো ঝর্নাটি অবস্থিত। গভীর বন ও তেমন প্রচারণা না থাকায় এই স্থানটিতে স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকদের খুব বেশি আনাগোনা থাকে না। মাধবকুন্ড থেকে পরিকুন্ড যাওয়ার একমাত্র উপায় পায়ে হাটা। যাওয়ার পথটি পাথরময় এবং সেই সাথে রয়েছে পানির প্রবাহ। পথে তেমন কোনো ভয় নেই তবে হাটার সময় একটু অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কেননা পানিতে ভিজে পায়ের নিচের পাথরগুলো পিচ্ছিল হয়ে থাকে।

যাতায়াত ব্যবস্থা
ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন, বিমান সকল পথেই মৌলভীবাজার যাওয়া যায়। ঢাকার সায়েদাবাদ, কমলাপুর, কল্যাণপুর সহ দেশের যেসকল স্থান থেকে মৌলভীবাজার জেলার বাস ছাড়ে সেখান থেকে মৌলভীবাজারের বাসে করে কুলাউড়া নামতে হয়। ঢাকা-মৌলভীবাজার রুটে চলাচলকারী বাসগুলোর মধ্যে রয়েছে শ্যামলী পরিবহন (কমলাপুর কাউন্টার: ৮৩৬০২৪১, ০১৭১৬-৯৪২১৫৪; আসাদগেট কাউন্টার: ০২-৮১২৪৮৮১, ৯১২৪৫১৪; ভাড়া: ৩৫০ টাকা), হানিফ এন্টারপ্রাইজ (সায়েদাবাদ কাউন্টার: ০১৭১৩-৪০২৬৭৩, ০১৭১৩-৪০২৬৮৪; ভাড়া: ৩৫০ টাকা), টি.আর ট্রাভেলস (সায়েদাবাদ ০১১৯০-৭৬০০০৩; কল্যাণপুর ০১১৯১-৪৯৪৮৬৪; ভাড়া: ৪৫০ টাকা)। ট্রেনে করে যেতে হলে ঢাকার কমলাপুর থেকে সিলেট রুটে চলাচলকারী ট্রেনে করে কুলাউড়া স্টেশনে নামতে হয়। ঢাকা থেকে যেসকল ট্রেন সিলেট রুটে চলাচল করে সেগুলো হলো - পারাবত এক্সপ্রেস (মঙ্গলবার বাদে প্রতিদিন সকাল ৬:৪০ মিনিটে), জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস (সপ্তাহের ৭ দিনই দুপুর ২ টায়) ঢাকা হতে ছেড়ে যায়। যোগাযোগ: বাংলাদেশ রেলওয়ে; ফোন: ৯৩৫৮৬৩৪,৮৩১৫৮৫৭, ৯৩৩১৮২২, ০১৭১১৬৯১৬১২। বিমান পথে যেতে হলে হযরত শাহজালাল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ফ্লাইট নং 4H-0511 এ করে অথবা বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এর সিলেটগামী (অভ্যন্তরীণ) যে-কোন ফ্লাইট এ করে সিলেট গিয়ে সেখান থেকে পাবলিক বাসে করে মৌলভীবাজার আসতে হয়। মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, রবি সপ্তাহের এই চার দিন ঢাকা-সিলেট রুটে বিমানে করে যাওয়া যায়। ভাড়া ৩০০০ টাকা। যোগাযোগ: ৮৯৩২৩৩৮, ৮৯৩১৭১২। 



কুলাউড়া থেকে সিএনজি অটোরিক্সায় করে সরাসরি মাধবকুন্ড যাওয়া যায় (ভাড়া ৪০০/৪৫০ টাকা)। এছাড়া পাবলিক বাসে করেও যাওয়া যায়। বাসে করে যেতে হলে কাঠালতলী বাজারে নেমে সেখান থেকে আবার সিএনজি অটোরিক্সায় করে মাধবকুন্ড যেতে হয় (ভাড়া ১৫০/২০০ টাকা)। মাধবকুন্ড পৌছে নির্ধারিত প্রবেশ টিকেট কেটে মাধবকুন্ড পর্যটন এরিয়ায় প্রবেশ করতে হয়। পর্যটন কেন্দ্রে প্রবেশ করে ঝর্নার দিকে যে রাস্তাটি রয়েছে সেই রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ হাটলে প্রথমে হাতের বা পাশে একটি শিব মন্দির চোখে পড়বে। শিব মন্দিরটির ঠিক বিপরীত দিকের রাস্তার পাশ দিয়ে একটি সিড়ি রয়েছে। সেই সিড়ি ধরে নিচে নামলে দেখা মিলবে মাধবকুন্ড ঝর্না থেকে বয়ে আসা পানির ছড়ার। সেই ছড়াটির সোজাসুজি পাথর বিছানো পথ ধরে ১০ থেকে ১২ মিনিট হাটলেই জঙ্গলের মধ্যে দেখা মিলবে স্বপ্নময় পরিকুন্ড ঝর্নার।

খাওয়া-দাওয়া
ভ্রমণে বের হলে অধিকাংশ মানুষই খাওয়া-দাওয়ার কথা ভুলে যায়। তারপরেও দিনশেষে কিছু একটা পেটে দিতে হয়। মাধবকুন্ড ঝর্নার পাশে পর্যটন কর্পোরেশনের একটি রেষ্টুরেন্ট রয়েছে। রেষ্টুরেন্টটিতে প্রতি বেলায় জনপ্রতি খেতে ২৫০/৩০০ টাকার মতো খরচ হয়। খাওয়ার খরচ একটু কমাতে চাইলে যেতে হবে কাঠালতলী বাজারে।

থাকার ব্যবস্থা
পর্যটকদের থাকার জন্য মাধবকুন্ডে একটি সরকারী বিশ্রামাগার রয়েছে। ২ রুম বিশিষ্ট এই বিশ্রামাগারটিতে রাত্রি যাপন করতে হলে কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ দিন আগে জেলা পরিষদ থেকে বুকিং দিতে হয়। 

ভাসানী নভোথিয়েটার / বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার ।




বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার ২০০২ সাল থেকে দর্শণার্থীদের জন্য উন্মূক্ত করা হয়। থিয়েটার ভবনটি ৫ তলার মতো দেখতে হলেও এতে ৩ টি ফ্লোর রয়েছে। এর প্রথম তলা এবং দ্বিতীয় তলা নিয়ে থিয়েটার। এই থিয়েটারে মোট ২০০ জন দর্শক বসার ব্যবস্থা রয়েছে।

প্রদর্শনীর বিষয়
থিয়েটারে ২টি বিষয়ের উপর চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। প্রথমটি ‍এ জার্নি টু ইনফিনিটি এবং দ্বিতীয়টি এই আমার বাংলাদেশ। প্রথম চলচ্চিত্রটি দ্বারা মহাকাশ সূর্য ও বিভিন্ন গ্রহ সমূহের ধারণা এবং দ্বিতীয় চলচ্চিত্রটি দ্বারা বাংলাদেশের প্রকৃতি উৎপত্তি এবং গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। থিয়েটারের অভ্যন্তরে কোন প্রকার খাদ্যদ্রব্য নিয়ে প্রবেশ করা যায় না। এছাড়া প্রদর্শনী চলার সময় মোবাইল ফোন, ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা ও আলো জালানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং প্রদর্শনী শুরু হওয়ার পর কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।

প্রদর্শনীয় মূল্য
থিয়েটারের সামনেই পূর্ব ও পশ্চিম পাশে দুটি করে মোট ৪টি কাউন্টার রয়েছে। থিয়েটারের টিকিট মূল্য জনপ্রতি ৫০ টাকা। তবে ২ বছরের নিচে বাচ্চার টিকিটের প্রয়োজন নেই। থিয়েটারের ভিতর একটি রাইড রয়েছে। নাম রাইড সিমুলেটর। এই রাইডে প্রতি ৫ মিনিটের জন্য ২০ টাকার টিকেট সংগ্রহ করতে হয়। মূলত শো শুরু হওয়ার ১ ঘন্টা পূর্ব থেকে পাওয়া যায়। প্রদর্শনীর সময় শনিবার, রবিবার, সোমবার ও বৃহস্পতিবার সকাল ১১.০০, দুপুর-১.০০ বিকেল ৩.০০, সন্ধ্যা-৭.০০ এবং শুক্রবার-সকাল ১০.০০,১১.৩০, ৩.০০, বিকেল ৫.০০, সন্ধ্যা ৭.০০।


সময়সূচী
নভোটিয়েটার বুধবার এবং এবং সকল সরকারী ছুটির দিনে থিয়েটার বন্ধ থাকে। এছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০.০০ থেকে সন্ধ্যা ৭.০০ পর্যন্ত খোলা থাকে।

গাড়ী পার্কিং
থিয়েটারে আন্ডার গ্রাউন্ড গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা রয়েছে। পার্কিং চার্জ প্রত্যেক বাস ৩০ টাকা, কার ১০ টাকা এবং মোটর সাইকেল ৫ টাকা


বিবিধ
থিয়েটারে পর্যাপ্ত পরিমাণ অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা, নিরাপত্তা সরঞ্জাম এবং লোকবল সিকিউরিটি, নিরাপত্তা রক্ষী রয়েছে। থিয়েটারের নিচতলায় পশ্চিম দিকে পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য পৃথক ভাবে ৮টি করে মোট ১৬ টি টয়লেট রয়েছে। নিচ তলায় অবস্থান।

ঠিকানা
বিজয় স্বরণীর দক্ষিণ পশ্চিম কোনায় বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার অবস্থিত। এর পশ্চিম পাশে সামরিক জাদুঘর রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ফোননম্বর ৯১৩৮৮৭৮, ৯১৩৯৫৭৭, ৮১১১১৩৪ এবং ওয়েব সাইটhttp://www.novotheatre.gov.bd

নিঝুম দ্বীপ ।


নিঝুম দ্বীপ বাংলাদেশের দক্ষিণে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অর্ন্তগত ছোট একটি দ্বীপ। সবাই এটিকে দ্বীপ হিসেবে উল্লেখ করলেও এটি আসলে সাগরের মোহনার অবস্থিত একটি চর। নোয়াখালীর দক্ষিণে মূল হাতিয়া পেরিয়ে এ দ্বীপে পৌঁছাতে পাড়ি দিতে হয় প্রমত্তা মেঘনা নদী। বঙ্গোপসাগরের কোলে উত্তর ও পশ্চিমে মেঘনার শাখা নদী, আর দক্ষিণ এবং পূর্বে সৈকত ও সমুদ্র বালুচর বেষ্টিত ছোট্ট সবুজ ভূখণ্ড নিঝুম দ্বীপ অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পর্যটকদের নিকট দর্শনীয় স্থান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। নিঝুম দ্বীপ সত্যিই নিঝুম। এখানে নেই পর্যটনের চাকচিক্য, বাতির ঝলক কিংবা যান্ত্রিক কোনো বাহনের বিকট শব্দ। ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায়, নিঝুম দ্বীপের পূর্ব নাম ছিলো চর ওসমান। ওসমান নামের একজন বাথানিয়া তার মহিষের বাথান নিয়ে প্রথম নিঝুম দ্বীপে বসতি গড়েন। তখন তার নামেই এই দ্বীপটির নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে হাতিয়ার একজন সাংসদ এই নাম বদলে দ্বীপটির নাম নিঝুম দ্বীপ রাখেন। স্থানীয় বনবিভাগের মতে, ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে প্রায় ১৪,০০০ একরের এই চরটি জেগে ওঠে। ১৯৭০ সালের আগে পর্যন্ত এখানে লোকজনের বসবাস ছিলো না। ১৯৭০ সালে বনবিভাগ এই দ্বীপে তাদের কার্যক্রম শুরু করে চার জোড়া হরিণ অবমুক্ত করণের মাধ্যমে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এক হরিণশুমারীতে পাওয়া তথ্যে জানা যায় সেই ১৯৭০-১৯৯৬ এই ২৬ বছরে হরিণের সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ২২,০০০ এ। সেই থেকে এই দ্বীপটিকে হরিণের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানেও অসংখ্য হরিণ রয়েছে দ্বীপটিতে।

অন্য আরেকটি সূত্র হতে জানা যায়, ১৯৪০-এর দশকে এ দ্বীপটি বঙ্গোপসাগর হতে জেগে ওঠা শুরু করে। চর গঠনের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে ৪০-এর দশকের শেষদিকে নিঝুম দ্বীপ তৃণচর বা গোচারণের উপযুক্ত হয়ে ওঠে। মাছ ধরতে গিয়ে হাতিয়ার জেলেরা নিঝুম দ্বীপ আবিষ্কার করে। ৫০-এর দশকের মাঝামাঝি নিঝুম দ্বীপে জনবসতি শুরু হয়। মূলত হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়ন থেকে কিছু জেলে পরিবার প্রথম নিঝুম দ্বীপে আসে। নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ইছা মাছ (চিংড়ি মাছ) ধরা পড়ত বিধায় জেলেরা এ দ্বীপের নাম দেয় 'ইছামতির দ্বীপ'। এ দ্বীপটিতে মাঝে মাঝে বালির ঢিবি বা টিলার মতো ছিল বিধায় স্থানীয় লোকজন এ দ্বীপকে বাইল্যার ডেইল বলেও ডাকত। কালক্রমে ইছামতি দ্বীপ নামটি হারিয়ে গেলেও স্থানীয় লোকেরা এখনো এ দ্বীপকে বাইল্যার ডেইল বলেই সম্বোধন করে। 

দ্বীপটির নৈগর্গিক সৌন্দর্য 


সমুদ্রের বুকে হেলে পড়ে অস্তগামী সূর্য, পাখির কলতান যেনো হাজার বছরের নিস্তব্ধতাকেও জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। ঝাকে ঝাকে মায়াবী হরিনের পদচারনায় মুখরিত এই জনপদ। যেদিকে চোখ যায় যতদূর চোখ যায় কেবল সারি সারি কেওড়া গাছ আর তার কোল ঘেষে বয়ে চলা নদী মুহুর্তেই মায়াবী জাদুর বন্ধনে বেধে ফেলে পর্যটকদের মন। সমুদ্রের বুক থেকে শুরু হয়ে সরু খাল ধরে গহীন বনের বুক চিরে এই দ্বীপটি অবস্থিত। চারিপাশে সবুজের বিচরণ। সেই সাথে রয়েছে সমুদ্রের স্বচ্ছ নোনা জল। চলতি পথে পানির নিচের সবুজ দৃশ্য ও মাছেদের ছুটোছুটির দৃশ্য দেখে পর্যটকদেরকে বারবার পানিতে ঝাপিয়ে পড়ার ইচ্ছে জাগিয়ে তোলে।

নিঝুম দ্বীপে পর্যটকদের জন্য ওয়েলকাম ড্রিংকস হিসেবে রয়েছে কচি ডাবের পানি। তবে এখানে ডাব বিক্রির জন্য কোনো হকার নেই। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে গাছ থেকে ডাব পাড়িয়ে খেতে হয়।

নিঝুম দ্বীপে পৌছে প্রথমেই পর্যটকরা হরিণ দর্শনের জন্য ছুটে যায় স্থানীয় কেওড়াবনের দিকে। হাজার হাজার হরিণের পদচারণায় মুখরিত থাকে এই বনটি। হরিণ দর্শনের জন্য এখানে রয়েছে ইঞ্জিন চালিত নৌকার ব্যবস্থা। নৌকায় করে সাগরের মোহনা থেকে সরু খাল ধরে বনের ভেতর যতদূর যাওয়া যায় শুধু সবুজ আর সবুজ, সেই সাথে গাছের ফাকে ফাকে দেখা মিলবে ঝাকে ঝাকে হরিণের পালের। সবল সতেজ হরিনের ছুটে চলা সে এক অপরূপ দৃশ্য। যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর। উল্লেখ্য এই দ্বীপটির কোথাও বালুর তেমন দেখা না মিললে আশ্চর্য হবার কোনো কারণ নেই। কেননা ভৌগোলিক কারণেই পুরো দ্বীপটাই কর্দমাক্ত মাটি দিয়ে গঠিত। বর্ষার সময় তা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। 

নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণের সবচাইতে উপযুক্ত সময় হলো শীতকাল। বর্ষাকালে গেলে কাদায় গোসল করার ১০০% সম্ভাবনা রয়েছে। আর গ্রীষ্মকালে গেলে মোকাবেলা করার সম্ভাবনা রয়েছে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের। সবদিক বিবেচনা করে শীতকালটাই নিঝুম দ্বীপ ভ্রসমণের জন্য সবচাইতে উপযুক্ত সময়।

তবে এই দ্বীপ এলাকায় জলদস্যুদের কিছুটা ভয় রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তারা বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম করে থাকে। অবশ্য এই সমস্যা সব সময় হয় না। বর্তমানে প্রশাসনের সজাগ দৃষ্টির কারণে জলদস্যুদের প্রকোপ অনেকটাই কমে গিয়েছে। 

যাতায়াত ব্যবস্থা
ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার সবচাইতে সহজ মাধ্যম হলো লঞ্চ। ঢাকার সদরঘাট থেকে এমভি পানামা-২ (০১৯২৪-০০৪৬০৮) ও এমভি টিপু-৫ (০১৭১১৩৪৮৮১৩) লঞ্চ দুটি ঢাকা-হাতিয়া রুটে চলাচল করে। ঢাকা থেকে ছাড়ে বিকাল ৫ টায় এবং হাতিয়ার তমরুদ্দি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়ে দুপুর সাড়ে বারোটায়। লঞ্চে যেতে মোটামুটি খরচ হয় এরকম ভাড়া ডেক ২০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ৭০০ টাকা, ডাবল কেবিন ১২০০ টাকা এবং ভিআইপি কেবিন ১৬০০ টাকা। সদরঘাট থেকে লঞ্চযোগে তমরুদ্দি ঘাটে নামতে হয়। সেখান থেকে নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার জন্য ইঞ্জিন চালিত ট্রলার রয়েছে। নিঝুম দ্বীপে দুটি ঘাট রয়েছে। একটি হচ্ছে নামার ঘাট এবং অন্যটি বন্দরটিলা ঘাট। নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে গেলে নামার ঘাটে নামাই সুবিধাজনক। কেননা এখানে রিসোর্ট রয়েছে। তমরুদ্দি লঞ্চ ঘাট থেকে নামার ঘাটে যেতে সময় লাগে ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট থেকে ২ ঘন্টা ৪৫ মিনিটের মতো। ভাড়া ভ্রমণকরীর সংখ্যার উপর নির্ভর করে। যেমন – ১৫ থেকে ২০ জন লোক একসাথে একটি ট্রলার রিজার্ভ করলে আপডাউন ভাড়া পড়ে ৬,০০০ থেকে ৭,০০০ টাকার মতো। আবার ২০ থেকে ৩০ জন লোক একসাথে একটি ট্রলার রিজার্ভ করলে আপডাউন ভাড়া পড়ে ৮,০০০ থেকে ৯,০০০ টাকার মতো। এছাড়া তমরুদ্দি ঘাট থেকে সড়ক পথে নিঝুম দ্বীপে যাওয়া যায়।

এছাড়া সড়কপথে তমরদ্দী লঞ্চঘাট থেকে নিঝুম দ্বীপ যেতে চাইলে, তমরদ্দী বাজার থেকে টেম্পুতে জাল্যাখালী (জালিয়াখালী) ঘাট অথবা বাসে করে জাহাজমারা ঘাটে এবং সেখান থেকে রিক্সাতে জাল্যাখালী (জালিয়াখালী) ঘাটে যেতে হবে। জাহাজমারা ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে সোজা বন্দরটিলা ঘাট। আগেই বলেছি নিঝুম দ্বীপের ঘাট দুইটি। এবং মূল ঘাট হচ্ছে নামার বাজার ঘাট। তাই বন্দরটিলা ঘাট থেকে যেতে হবে নামার বাজার। ভাড়া ১৫০ টাকার মতো পড়ে। 

এছাড়া যারা ঢাকা থেকে সড়ক পথে যেতে চান তাদের জন্য ঢাকার যাত্রাবাড়ী তথা সায়েদাবাদ থেকে রয়েছে নোয়াখালীর বাস। ঢাকা থেকে প্রথমে যেতে হয় মাইজদী সোনাপুর। সোনাপুর থেকে যেতে হবে চেয়ারম্যান ঘাট। সোনাপুর থেকে চেয়ারম্যান ঘাটের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। যানবাহন হিসেবে রয়েছে বাস, টেম্পু ও টু-স্ট্রোক বেবিট্যাক্সি। সোনাপুর থেকে থেকে চেয়ারম্যান ঘাট যেতে বেবিতে ভাড়া পড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার মতো। চেয়ারম্যান ঘাট পৌছে সেখান থেকে ইঞ্জিন চালিত ট্রলার অথবা সী ট্রাকে করে প্রথমে হাতিয়া চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যেতে হয় হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে। তারপর নলচিরা ঘাট থেকে যেতে হয় দক্ষিণদিকে জাহাজমারা নামক ঘাটে। সময় লাগে ৩০ মিনিটের মতো। আবার জাহাজমারা থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে যেতে হয় নিঝুম দ্বীপে। তবে, দলবেধে গেলে সরাসরি চেয়ারম্যান ঘাট থেকে ট্রলার রিজার্ভ করে নিঝুম দ্বীপে যাওয়া যায়। উল্লেখ্য এই পথে নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার সময় জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। 

ট্রেনে করে যেতে চাইলে প্রথমে কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে নোয়াখালী রেলওয়ে ষ্টেশন যেতে হবে। এরপর বাসে নোয়াখালী চেয়ারম্যান ঘাট হয়ে উপরের রুট অনুযায়ী নিঝুম দ্বীপে যাওয়া যায়। এ ছাড়া বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকেও সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে চট্টগ্রাম থেকে একটি জাহাজ হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। 

থাকার ব্যবস্থা
নিঝুম দ্বীপে ভ্রমণে যাওয়ার আগে ঢাকা থেকেই সেখানে থাকার ব্যবস্থা ঠিক করে যাওয়া ভালো। নাহলে পরবর্তীতে সেখানে গিয়ে নানা ধরনের বিপত্তিতে পড়তে হয়। পর্যটকদের থাকার জন্য নিঝুম দ্বীপে নিঝুম রিসোর্ট নামে একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এখানে ৯টি দুই ও তিন বেডের রুম রয়েছে। এছাড়া ২২ বেড বিশিষ্ট ৩টি ডরমিটরি রয়েছে। এখানে থাকতে হলে ঢাকায় অবকাশ পর্যটন লি: এ যোগাযোগ করতে হয়। এই অফিসটি ঢাকার ১৭ নিউ ইস্কাটন রোডের আলহাজ্জ সামসুদ্দিন ম্যানশন এর নবম তলায় অবস্থিত। ফোন: ০১৫৫২৩৭২২৬৯, ৮৩৫৮৪৮৫, ৯৩৪২৩৫১, ৯৩৫৯২৩০।নিঝুম রিসোর্টে প্রতিটি দুই বেডের রুমের ভাড়া ১,০০০ টাকা এবং প্রতিটি ৩ বেডের ফ্যামিলি রুমের ভাড়া ২,০০০ টাকা। আর ১২ বেডের ডরমিটরি রুমের ভাড়া ২,৪০০ টাকা এবং ৫ বেডের ডরমিটরি রুমের ভাড়া ১,২০০ টাকা। উল্লেখ্য প্রতি রুমে একজন করে থাকতে পারে। রুম সংকট হলে সর্বোচ্চ দুই জন থাকতে পারে এবং সেজন্য অতিরিক্ত ১০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া সরাসরি নিঝুম রিসোর্টেও যোগাযোগ করতে পারেন। নিঝুম রিসোর্টে যোগাযোগের ফোন নম্বর ০১৭২৪-১৪৫৮৬৪।এছাড়া মসজিদ বোর্ডিং নামে আরও একটি বোর্ডিং রয়েছে। এখানে সিঙ্গেল ও ডাবল মিলিয়ে ৮টি রুম রয়েছে। নিঝুম রিসোর্টে জেনারেটর ও এটাচর্ড বাথরুমের ব্যবস্থা থাকলেও এখানে জেনারেটর ও এটার্চড বাথরুমের কোনো ব্যবস্থা নেই। মসজিদ বোর্ডিং এ যোগাযোগের ফোন নম্বর ০১৭২৭-৯৫৮৮৭৯।এখানে প্রতিটি সিঙ্গেল রুমের ভাড়া ১২০/১৫০ টাকা এবং ডাবল রুমের ভাড়া ২০০/২৫০ টাকা। 

এছাড়াও এখানকার স্থানীয় বাজারে খুব সস্তায় অল্প দামে তিন-চারটি আবাসিক বোডিং রয়েছে। আরও রয়েছে বন বিভাগের একটি চমৎকার বাংলো। পাশেই আছে জেলা প্রশাসকের ডাক বাংলো। এগুলোতে আগে থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা যায়। 

খাওয়া-দাওয়া
স্থানীয় নামার বাজারে পর্যটকদের খাবার-দাবারের সব রকমের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে সকালের নাস্তা, দুপুর ও রাতের খাবার, চা, বিস্কুট সবকিছুই পাওয়া যায়।