সোমবার, ১৫ জুন, ২০১৫

সোনা ঝরা সোনার দ্বীপ।

সোনা ঝরা সোনার দ্বীপ।   



প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি সোনারচর। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দক্ষিণ সীমানায় বঙ্গোপসাগরের একেবারে কোল ঘেঁষে এর অবস্থান। এখানে সবুজ প্রকৃতি, বন্যপ্রাণী, পাখির ঝাঁক, জেলেদের উচ্ছ্বাস আর সাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশি মিলে নয়নাভিরাম এক সৌন্দর্যের অধরা সৃষ্টি হয়েছে। সাগরে যখন জোয়ারের পানি উথলে ওঠে তখন অনন্য এক সৌন্দর্য বিকশিত হয় সোনারচরে। প্রায় দশ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের সমুদ্রসৈকতের যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার রয়েছে সুযোগ। ঢেউয়ের তালে তালে দুলতে থাকা জেলে নৌকার বহর। সাগরে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। এমন মনোরম পরিবেশ কার না মন টানে? বিশেষ করে প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এর আবেদন অন্য রকমের। 
যে কারণে নাম হলো সোনারচর : সোনার চরে সোনা নেই, আছে সোনা রঙের বালু। সকাল কিংবা শেষ বিকেলের রোদের আলো যখন সোনারচরের বেলেভূমিতে পরে, তখন দূর থেকে পুরো দ্বীপটাকে সোনালি রঙের থালার মতো মনে হয়। বালুর ওপরে সূর্যের আলোয় চোখের দৃষ্টি চিক চিক করে। মনে হবে যেন কাঁচা সোনার প্রলেপ দেয়া হয়েছে দ্বীপটিতে। ধারণা করা হয়, বিশেষ এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই দ্বীপটির নাম রাখা হয়েছে সোনারচর। 
যেভাবে যেতে হবে : সোনারচরে যাতায়াতের একাধিক পথ রয়েছে। ঢাকা থেকে পটুয়াখালী পৌঁছতে হবে বাস অথবা লঞ্চে। পটুয়াখালী থেকে প্রথমে গলাচিপা উপজেলা সদর এবং সেখান থেকে সড়কপথে দশ কিলোমিটার দক্ষিণে পানপট্টি লঞ্চঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে আগুনমুখা মোহনা পেরিয়ে দক্ষিণে ডিগ্রি নদীর বুক চিরে একটু বাঁয়ে যেতেই আরেকটি নদী বুড়াগৌরাঙ্গ। সামনে গিয়ে বাঁক ঘুরতেই এগিয়ে চলা দাঁড়ছিড়া নদী। দুই পাশে ঘন ম্যানগ্রোভ গাছের বাগান। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ডাক, নদীর বুকজুড়ে গাঙশালিকের অবাধ বিচরণ। সামুদ্রিক হাওয়ার মৃদুমন্দ ছোঁয়া। সব মিলিয়ে এক অন্য রকম ভালোলাগার অনুভূতি সোনারচরের যাত্রা পথে। ট্রলার কিংবা লঞ্চে আগুনমুখার মোহনা থেকে ঘণ্টা দুয়েক এগোলেই চোখে পড়বে মায়াবী দ্বীপ চর তাপসী। তাপসীর বাঁকে পৌঁছতেই সোনারচরের হাতছানি। তাপসী থেকে ৩০ মিনিটের পথ দক্ষিণে এগোলেই সোনারচর। এ ছাড়া পানপট্টি থেকে লঞ্চ বা ট্রলারে রাঙ্গাবালীর কোড়ালিয়া লঞ্চঘাট এসে সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে সোনারচর যাওয়া যায়। রাঙ্গাবালী উপজেলা সদর থেকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে সোনারচর যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
স্পিডবোট নিয়েও যাওয়া যেতে পারে সোনারচরে। রাঙ্গাবালী উপজেলা সদর থেকে স্পিডবোটে সোনারচরে যেতে সময় লাগে মাত্র এক ঘণ্টা। আবার সাগরকন্যা কুয়াকাটা থেকেও সোনারচরে যাওয়া যেতে পারে। যেতে হবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। দক্ষিণের আরেক জেলা ভোলা থেকেও সোনারচরে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সে পথ যথেষ্ট দুর্গম। নদীপথে সময় লাগবে কমপেক্ষ ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা।
যা দেখবেন : সোনারচরে রয়েছে প্রায় দশ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের বিশাল সমুদ্র সৈকত। সৈকতের যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার রয়েছে অপূর্ব সুযোগ। এখানে রয়েছে পাঁচ হাজার একরের বিশাল বনভূমি। বন-বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, সুন্দরবনের পরেই আয়তনের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। সোনারচরের বিশাল বনভূমির মধ্যে ছড়িয়ে আছে দেড় শতাধিক ছোট-বড় খাল। ছোট্ট নৌকা বা ইঞ্জিন চালিত ট্রলার নিয়ে এসব খালে ভেসে ভেসে দেখা যায় বিচিত্র সব পাখপাখালির বিচরণ। বহু হরিণ আর বানর রয়েছে সোনারচরে। তবে ঘন অরণ্যের কারণে এগুলোর দেখা মেলে খুব কম। বনাঞ্চলের কাছাকাছি গেলে হয়তো সহজেই চোখে পড়বে বুনো মোষ। দেখা মিলবে বুনো গরুর। এসব গরু-মোষ দলছুট হয়ে বুনো হিংস্র পশুতে পরিণত হয়েছে। এর বাইরে এখানে রয়েছে শূকর, বানর, মেছো-বাঘসহ আরো বিচিত্র সব বন্য প্রাণী। মনমুগ্ধকর সৌন্দর্যের নানা রকম প্রাকৃতিক আয়োজন রয়েছে এ দ্বীপটিতে। শীতের সময় বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয় পুরো দ্বীপ ও পাশের এলাকা। সোনারচর বনাঞ্চলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ম্যানগ্রোভের পাশাপাশি নানান জাতের গাছপালার বাগান করা হয়েছে। যা কারো দৃষ্টি কাড়বে। রয়েছে সমুদ্র উপভোগের সুযোগ। ঢেউয়ের তালে সমুদ্র স্নানেও রয়েছে ভিন্ন আমেজ। এখানে গেলে দেখা মিলবে হাজারো জেলের। সাগর থেকে তুলে আনা টাটকা মাছের স্বাদও নেয়া যাবে এখান থেকে। শুঁটকি পল্লীতেও ঘুরে বেড়ানো যাবে। দেখা যাবে লালকাঁকড়া যেন চাদর বিছিয়ে রেখেছে। মোট কথা একদিকে দূর আকাশ বিস্তীর্ণ সাগর ও বনাঞ্চল। দু’টোরই স্বাদ মিলবে সোনারচরে। সে সঙ্গে বন্যপ্রাণী আর পাখির কলরবে প্রকৃতির সৌন্দর্যপিপাসুরা সোনার চরের রূপে মুগ্ধ হবেনই। 
যেখানে থাকবেন : রাত কাটানোর মতো নিরাপদ আরামদায়ক কোনো ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। তবে পর্যটকদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ছোট্ট তিন কক্ষের একটি বাংলো। ইচ্ছে করলে রাতে সেখানে থেকে যেতে পারেন। এ ছাড়া রয়েছে বনবিভাগের ক্যাম্প। সেখানে কিছুটা কষ্ট হলেও রয়েছে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা। চাইলে সূর্যাস্ত দেখার পর ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারে ৩০ মিনিটে চলে যেতে পারেন চরমোন্তাজে। সেখানে রয়েছে বন বিভাগ, বেসরকারি সংস্থা স্যাপ বাংলাদেশ ও মহিলা উন্নয়ন সমিতির ব্যবস্থাপনায় রাত যাপনের মতো মোটামুটি সুবিধা সম্পন্ন বাংলো। রয়েছে হোটেল। রাঙ্গাবালীতে শুধু সোনারচরই নয় রয়েছে মৌডুবী, জাহাজমারা, তুফানিয়া ও শিপচরসহ আরো কয়েকটি দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে। এর সব দ্বীপই সাগরের বুক চিরে জেগে ওঠা। মোট কথা দুই-তিন দিন ঘুরে বেড়িয়ে সোনারচরসহ আশপাশের দ্বীপগুলো দেখে ফিরতে পারেন।






আজ এ পর্য‍্ন্তই। ভালো থাকবেন সবাই। ধন্যবাদ। 



বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক,মৌলভীবাজার ।

বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক। 


সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার শহরের প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণ পাশে এই ইকো পার্কের অবস্থান। ছোটবড় বেশকিছু টিলা ঘেরা চিরহরিৎ পত্রঝরা প্রকৃতির এ বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল ১৯১৬ সালে। এর পুরনো নাম লাউডগা রিজার্ভ ফরেস্ট।
২০০৬ সালে এ বনের প্রায় ৮৮৭ একর বনাঞ্চল ও আশপাশের এলাকাকে ইকোপার্ক হিসেবে ঘোষণা করে বনবিভাগ।

নানান গাছপালা আর বন্যপ্রাণীতে সমৃদ্ধ বর্ষিজোড়া জঙ্গল। বনের প্রধান উদ্ভিদ শাল আর গর্জন। আরও আছে সেগুন, লোহাকাঠ, জারুল, তেলশুর, চিকরাশি ইত্যাদি। এছাড়া আগর, আমলকি, বহেরাসহ নানান ঔষধি গাছও আছে।
নানান বন্যপ্রাণীর বিচরণ এ বনে। উল্লেখযোগ্য হল বানর, হনুমান, কাঠবিড়ালী, মায়া হরিণ, সজারু, বনরুই, মেছোবাঘ, গুইসাপসহ বিভিন্ন ধরনের সাপ ইত্যাদি। 

কীভাবে যাবেন 
ঢাকা থেকে সড়ক পথে মৌলভীবাজার সদরে যাওয়া যায়। ফকিরাপুল, সায়দাবাদ থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সিলেট এক্সপ্রেস ইত্যাদি বাস যায় মৌলভী বাজার। ভাড়া নন এসি বাসে সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা।
মৌলভীবাজার শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে বর্ষিজোড়া বনাঞ্চল। শহর থেকে অটোরিকশা কিংবা রিকশায় যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন
মৌলভীবাজার শহরের কাছে থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা দুসাই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা। মৌলভীবাজারের গিয়াসনগরের শ্রীমঙ্গল রোডে অবস্থিত এ রিসোর্টে পাবেন আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা। যোগাযোগ: ০১৬১৭০০৫৫১১।
এছাড়া মৌলভীবাজার জেলা শহরে সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। শ্রীমঙ্গল রোডে হোটেল সোনাগাঁও, শহরের কুসুমবাগে হোটেল শেরাটন প্লাজা, সাইফুর রহমান রোডে হোটেল হেলাল। এসব হোটেলে প্রতিদিন ৩শ’ থেকে ১ হাজার ৫শ’ টাকায় থাকার ব্যবস্থা আছে।  



শীতের মৌসুমে ইকোপার্ক‍্ হতে ঘুরে আসুন। আশা করি ভালো লাগবে। ধন্যবাদ সবাইকে। 


আমের মৌসুমে রাজশাহী ।

আমের মৌসুমে রাজশাহী  





বাংলাদেশের উত্তরের এই জেলায় নানান দর্শনীয় স্থানের জন্য সমৃদ্ধ। আমের এই মৌসুমে বেড়িয়ে আসতে পারেন জেলা শহর রাজশাহী থেকে।
এ ভ্রমণের শুরু করুন রাজশাহী শহর থেকে। সকালের নাস্তা সেরে একটু ঘুরে দেখতে পারেন পুরনো এ শহর। বাইপাস সড়ক ধরে রাজশাহী শহরে প্রবেশ করলে নওদাপাড়া এলাকার চৌরাস্তায় আছে আমের ভাস্কর্য। বিশাল ঝুড়ির মধ্যে রাখা আম চত্ত্বরের তিনটি পাকা আম যেন আমের শহরেই স্বাগত জানাচ্ছে।
পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত প্রায় ৯৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিভাগীয় শহর রাজশাহী। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ শহরের উত্থান। আগে এ জেলার সদর দপ্তর ছিল নাটোরে। ১৮২৫ সালে সেটি নাটোর থেকে রাজশাহীতে স্থানান্তরিত হয়। রেশম উৎপাদন কেন্দ্র এবং পদ্মা নদীর তীরবর্তী শহর হওয়ায় ইংরেজ বণিকদের সহজেই নজর কাড়ে রাজশাহী। পর্যায়ক্রমে ওলন্দাজ, ফরাসি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে এ শহরে। ওলন্দাজ রেশম কারখানার ভবনটি ছিল বড়কুঠি নামে পরিচিত।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইউরোপীয় সেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদর দফতর বসেছিল বড়কুঠিতে। উনিশ শতকের শেষ দিকে বড়কুঠি ব্রিটিশদের নিকট থেকে মেদিনীপুর জমিদার কিনে নেয়। ১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের পর একে বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের গুদামঘর করা হয়। 

আমের বাজার,রাজশাহী। 

১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বড় কুঠি হয় উপাচার্যের বাসভবন ও কার্যালয়। শহরের প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলো হলো শাহেববাজর, রানীবাজার, রেশম পট্টি, ঘোড়ামারা, হাতেমখানা, দরগাপাড়া, কুমারপাড়া, বোয়ালিয়া ইত্যাদি।
১৮৭৬ সালে রাজশাহী পৌরসভা ও ১৯৯১ সালে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয় রাজশাহী শহর।

শহর ঘুরে চলে যেতে পারেন বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে। এ অঞ্চলের প্রত্নতাত্তিক গুরুত্ব সম্পর্কে সাম্যক ধারণা মিলবে এখান থেকে। রাজশাহী সদর হাসপাতালের সামনে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন সংগ্রহশালা বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। নাটোরের দিঘাপাতিয়ার জমিদার শরৎ কুমার রায়, আইনজীবি অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রামাপ্রসাদ চন্দ্র পুমখ ব্যক্তির প্রচেষ্টায় ১৯১০ সালে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৬ সালে মূল জাদুঘর ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল। ১৯৬৪ সালে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের দায়িত্ব বর্তায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। আটটি গ্যালারিতে প্রায় দেড় হাজার প্রস্তর ও ধাতব মূর্তি, দুই হাজারেরও বেশি প্রাচীন মুদ্রা, প্রায় এক হাজার পোড়ামাটির ফলক ছাড়াও হাজারও নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে এ জাদুঘরে।
এপ্রিল থেকে অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত, নভেম্বর থেকে মার্চ সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে এটি। শুক্রবার খোলা থাকে দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষিত ছুটির দিনে এটি বন্ধ থাকে। 

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর দেখে চলে যান শাহ মখদুমের (র) সমাধি সৌধে। রাজশাহী সরকারী কলেজের কাছে দরগা পাড়ায় শায়িত আছেন দরবেশ শাহ মখদুম (র)। ১২৮৭ সালে তিনি বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে আসেন। ১৩১৩ সালে চিরকুমার এ দরবেশ মৃত্যুবরণ করেন। আলীকুলী বেগ নামে তার এক অনুসারী ১৬৩৫ সালে তার সমাধির উপরে এক গম্বুজ বিশিষ্ট সৌধ নির্মাণ করেন। প্রতিবছর আরবী মাসের ২৭ রজব এখানে উরস অনুষ্ঠিত হয়। আর ১০ মহররম এখান থেকে বের হয় তাজিয়া মিছিল। 
শাহ মখদুমের (র) সমাধির একটু সামনেই আছে টি বাঁধ। রাজশাহী শহরের পাশে পদ্মার তীরে ইংরেজি টি আকৃতির বাঁধ শহরের অন্যতম বেড়ানোর জায়গা। পদ্মার শীতল বাতাসের পরশ নিতে প্রতিদিন হাজারও মানুষ এখানে জড়ো হন। পদ্মায় এখন পানি এসছে, এখান থেকে নৌকা ভাড়া করে তাই ঘুরে আসতে পারেন পদ্মার কোনো চর থেকে।
দুপুর পর্যন্ত এ এলাকাগুলো বেড়াতে পারেন। দুপুরের খাবার শেষে বেড়াতে আসুন বিসিক শিল্প এলাকায়। শহরের এ শিল্প এলাকায় আছে বেশ কিছু রেশম শিল্প। এখানকার সফুরা রেশম কারখানায় দর্শনার্থীদের প্রবেশে কোনো বাধা নেই। পোকা থেকে রেশম তৈরির বিভিন্ন পর্যায় দেখতে পাবেন এখানে। তুলনামূলক কম দামে এখান থেকে রেশমের কাপড়ও কিনতে পারবেন।
সফুরা দেখে চলে যেতে পারেন মুক্তি যুদ্ধের স্থাপনা স্মৃতি অম্লানে। শহরের কেন্দ্রস্থলে শহীদ ক্যাপ্টেন বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর সড়কের দ্বীনেভদ্রা এলাকায় এটির অবস্থান। স্থপতি রাজিউদ্দিন আহমদের এ নকশায় ১৯৯১ সালের ২৬ শে মার্চ এর উদ্বোধন হয়। সৌধে মোট তিনটি স্তম্ভ আছে। প্রতিটি স্তম্ভের গায়ে ২৪টি করে ধাপ। এগুলোর বৈশিষ্ট্য হল ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আন্দোলনের ক্রমবিবর্তন ও স্বাধীনতার ফসল।
প্রতিটি স্তম্ভে ১০টি করে মোট ৩০টি ছিদ্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের নির্দেশ করা হয়েছে। বেদিমূলে রাখা আছে নীল শুভ্র পাথরের আচ্ছাদন, যা দুই লাখ নির্যাতিত নারীর বেদনাময় আর্তির কথা ইঙ্গিত করে। সৌধের চূড়ায় আছে বাংলাদেশের মানচিত্রের লালগোলক যা স্বাধীনতা যুদ্ধের উদীয়মান লাল সূর্যের প্রতীক। 
স্মৃতি অম্লান থেকে কাছের দূরত্বেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। রাজশাহী শহরের পাশে অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমেই দেখে নিন মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য সাবাশ বাংলাদেশ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার সবুজ চত্বরে মুক্তাঙ্গনের উত্তরপাশে এটি অবস্থিত। রাকসু এবং দেশের ছাত্রজনতার অর্থ সাহায্যে শিল্পী নিতুন কুণ্ডু এই ভাস্কর্যটি বিনা পারিশ্রমিকে নির্মাণ করেন। ১৯৯২ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এটি উদ্বোধন করেন। এই স্মৃতিস্তম্ভে আছে দুজন মুক্তিযোদ্ধার মূর্তি। একজন অসম সাহসের প্রতীক, অন্য মুক্তিযোদ্ধার হাত বিজয়ের উল্লাসে মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে পতাকার লাল সূর্যের মাঝে।
এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আছে সুবর্ণজয়ন্তী টাওয়ার, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি ইত্যাদি। সবুজে ঘেরা ক্যাম্পাসে ঘুরতে ঘুরতে দেখে নিতে পারেন এসবকিছুই।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশ পথে রাজশাহী যাওয়া যায়। ঢাকার কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে দেশ ট্রাভেলস ও গ্রীন লাইন পরিবহনের এসি বাস যায় রাজশাহী। ভাড়া ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা।
এছাড়া ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে শ্যমলি পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ন্যাশনাল ট্রাভেলস, বাবলু এন্টারপ্রাইজ প্রভৃতি পরিবহন প্রতিষ্ঠানের বাস যায় রাজশাহী। ভাড়া ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা।
ঢাকার কমলাপুর থেকে রোববার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন সিল্কসিটি এক্সপ্রেস এবং মঙ্গলবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ১১টা ১০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পদ্মা এক্সপ্রেস। ভাড়া শোভন চেয়ার সাড়ে ৩শ’ টাকা, স্নিগ্ধা ৬০৪ টাকা, এসি সিট ৭২৫ টাকা, এসি বার্থ ১ হাজার ৮১ টাকা।
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ (সর্বনিম্ন ভাড়া ৩ হাজার ৩শ’ টাকা)। ইউনাইটেড এয়ারের (সর্বনিম্ন ভাড়া ৪ হাজার ২৫০ টাকা) বিমান চলাচল করে রাজশাহীতে।
কোথায় থাকবেন
রাজশাহী শহরে বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। শহরের চিড়িয়াখানার পাশে আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল (০৭২১-৭৭৫২৩৭)। ঢাকার পর্যটন করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় (০২-৮৮৩৩২২৯, ৮৮৩৪৬০০) থেকেও এ হোটেলের বুকিং দেয়া যায়। এ হোটেলের এসি একক কক্ষ ১ হাজার ৯শ’ টাকা। এসি দ্বৈত কক্ষ ২ হাজার ৬শ’ টাকা। সুইট ৪ হাজার ৬শ’ টাকা।
রাজশাহী শহরের অন্যান্য হোটেল হল গণকপাড়ায় হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল (০৭২১-৭৭৬১৮৮)। শিরোইলে হোটেল হকস্ ইন্ (০৭২১-৮১০৪২০)। সাহেব বাজারে হোটেল মুক্তা ইন্টারন্যাশনাল (০৭২১-৭৭১১০০)। বিন্দুর মোড়ে হোটেল ডালাস ইন্টারন্যাশনাল (০৭২১-৮১১৪৭০)। মালোপাড়ায় হোটেল শুকরান (০৭২১-৭৭১৮১৭) ইত্যাদি। এসব হোটেলে ৫শ’ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় কক্ষ আছে। 
প্রয়োজনীয় তথ্য
এই সময়ে রাজশাহীতে প্রচণ্ড গরম। স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩১ ডিগ্রী সেলসিয়াসেরও বেশি হয়। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকে বলে গরমও বেশি অনুভূত হয়। তবে মাঝে মধ্যে বৃষ্টি গরম থেকে স্বস্তি দেবে। এ ভ্রমণে তাই হালকা সুতির কাপড় পরা ভালো। সঙ্গে ছাতা, রোদ টুপি, রোদ চশমা ইত্যাদি নিতে ভুলবেন না। 



আমের মৌসুমে ঘুরে আসুন আমের শহর রাজশাহী হতে। ধন্যবাদ সবাইকে। 



তুফানিয়া থেকে জাহাজমারা ।

তুফানিয়া থেকে জাহাজমারা  ।  






চার দিকে সমুদ্রের জলরাশি। সৈকতের তটরেখায় লাল কাঁকড়াদের ছোটাছুটি। শেষ বিকেলে দিগন্ত রেখায় সূর্যাস্তের দৃশ্য। ভোরে কুয়াশার আভা ভেদ করে পুব আকাশের বুক চিরে লাল সূর্য ওঠার মনোরম দৃশ্য। এরই মাঝে সকাল-দুপুর-বিকেল পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা দ্বীপ। 
এটা হচ্ছে বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে সমুদ্রের বুকে জেগে থাকা দ্বীপ তুফানিয়ার গল্প। 
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য নিয়ে জেগে আছে নয়নাভিরাম এ দ্বীপ। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে এ দ্বীপের অবস্থান। আর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে এর দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার।
এ দ্বীপের অন্য প্রান্তে রাঙ্গাবালী উপজেলার বড় বাইশদিয়ায় সমুদ্রপাড়ে রয়েছে আরেকটি সমুদ্রসৈকত, যার নাম জাহাজমারা। পর্যটন মওসুমে কিছু ট্রলার পর্যটকদের নিয়ে তুফানিয়া ও জাহাজমারায় যাতায়াত করে। 
কুয়াকাটা থেকে কিংবা রাঙ্গাবালী থেকে এসব স্থানে ট্রলারে যাতায়াতের সুযোগ রয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে পর্যটকেরা এসব স্থানে আসেন কিছুটা প্রশান্তির খোঁজে।
অথচ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এসব স্থানে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠলে পর্যটকদের যাতায়াত সহজ হতে পারে, আর সরকারও আয় করতে পারে বিপুল রাজস্ব।
তবে এখন পর্যন্ত এখানে লোকবসতি গড়ে ওঠেনি। আছে নিবিড় সবুজের সমারোহ। সৈকতে অগণিত লাল কাঁকড়ার ঝাঁক। সরকার এটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা না করলেও পর্যটকেরা এখানে আসছেন। ধ্বংস করছেন দ্বীপের সৌন্দর্য। 



পর্যটনকে কেন্দ্র করে দ্বীপের নির্দিষ্ট স্থানে পর্যটকদের ভ্রমণের সুযোগ করে দিলে বাঁচবে পরিবেশ। দ্বীপে রয়েছে সবুজের মনোরম সমারোহ। ১৯৭৪-৭৫ ও ২০০৭-০৮ সালে বন বিভাগ দুই দফায় এই দ্বীপে বনায়ন করে। ৫০০ একর বিস্তীর্ণ বনভূমিতে রয়েছে কেওড়া, ছইলা, গেওয়া, বাবলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে সাগরের বুক চিরে জেগে উঠছে এক সবুজ বনভূমি। 
সমুদ্রের বুকে জেগে থাকা তুফানিয়া একটি অন্যরকম দ্বীপ। এই দ্বীপের মূল বাসিন্দাই হচ্ছে লাল কাঁকড়া। যাদের উপস্থিতিতে সমুদ্রের রুপালি সৈকত যেন রক্তিম হয়ে ওঠে। 
জনমানবশূন্য দ্বীপে যখন মানুষের উপস্থিতি টের পায় এই কাঁকড়াগুলো তখন এদিক-ওদিক ছুটতে থাকে । দ্রুত আশ্রয় নেয় গর্তে। আবার অনেক কাঁকড়া ব্যস্ত হয়ে নিজেদের লুকানোর চেষ্টা করে বালুর ভেতরে। মানুষের আনাগোনায় দ্বীপে লাল কাঁকড়ারা নিরাপদ নেই। এদের নিরাপদ আবাসভূমি হুমকির মুখে পড়েছে।
বঙ্গোপসাগরের বুকে বিশাল এই দ্বীপ জেগে উঠতে শুরু করে গত শতকের ষাটের দশকে। তখন এই দ্বীপে সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ত। 
সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ এমনভাবে ভেঙে পড়ত, যা দেখলে মনে হতো দ্বীপের ওপরই যেন তুফান বইছে। সেই থেকে জেলেরা এই দ্বীপের নাম দিয়েছেন ‘তুফানিয়া’।
মৌডুবি বাজারের কাছে বেড়িবাঁধের বাইরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে জেগে আছে এ এলাকার আরেক সম্ভাবনাময় স্থান জাহাজমারা। সমুদ্রতীরে দীর্ঘ সৈকতের পাশে রয়েছে বন বিভাগের ঘন বনাঞ্চল। সমুদ্রের ঢেউ আর সবুজ প্রকৃতি এ এলাকার পরিবেশকে করে তুলেছে মোহনীয়।
জাহাজমারার স্থানীয় লোকজন জানালেন, মওসুমে অনেক কষ্ট করে এখানে কিছু লোকজন বেড়াতে আসেন। অনেকে আবার আসেন পিকনিক করতে। সড়ক পথে যাতায়াতে সমস্যা বলে এখানে দূরের লোকজন আসেন ট্রলারে। সুযোগ করে দিলে এই নির্জনে বহু পর্যটক আসতে পারেন বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা।
এলাকাবাসি  বলেন, ‘শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় এখানে চাইলেও বাইরে থেকে লোকজন আসতে পারে না। এসব পর্যটনকেন্দ্রের সম্ভাবনা বিকাশে বিশাল অট্টালিকা বানানোর প্রয়োজন নেই। পর্যটন মওসুমে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলে আর কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলেই এখানে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে।’  তাদের আরো অভিমত , ‘পর্যটন বিকাশে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। 
সড়কপথ তৈরি যে বাধ্যতামূলক তা নয়। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে সরাসরি লঞ্চ যোগাযোগের ব্যবস্থা করলেও পর্যটকেরা আসতে পারেন। অন্তত পর্যটন মওসুমের কথা বিবেচনায় রেখে এমন ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।’ পর্যটন বিকাশের মধ্য দিয়ে এ এলাকার উন্নয়ন ঘটবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
সময় কাটানোর জন্য মানুষ প্রকৃতির কাছে যায়। আর এখানকার প্রকৃতিই এমন যেন আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাই অবসর সময়ে ঘুরে আসতে পারেন দ্বীপ তুফানিয়ায়। 



বাংলাদেশ কত সুন্দর তা সত্যিই চোখ মেলে দেখা হয়ে ওঠে না। আবার অনেকেই হয়তো জানতেই পারে না। তাই ঘুরে আসুন এই দ্বীপে, সময়ের সাথে প্রকৃতির কাছে। 







সোমবার, ৮ জুন, ২০১৫

রাঙ্গামাটির ছাদ !

রাঙ্গামাটির ছাদ !   



রাঙামাটির অনেকটা অংশই দেখে যায় সাজেক ভ্যালি থেকে। বাঘাইছড়ি উপজেলা থেকে ৩০ কিলোমিটারের দুরের সাজেকের পুরোটাই পাহাড়ে মোড়ানো পথ। ভৌগলিক অবস্থান রাঙামাটিতে হলেও যাতায়াতের সহজ পথ খাগড়াছড়ি হয়ে। এবারে সাজেক ভ্রমণের শুরুটা হলো খাগড়াছড়ি দিঘীনালা থেকে, ভ্রমণযান মোটরবাইক। দিঘীনালা থেকে সড়ক পথে সাজেকের দু’তিন ঘণ্টার দূরত্ব। সকালের ঘন কুয়াশায় নিজেকে ঢেকে রওনা হলাম পাহাড়ের পথ ধরে। কেবল আমরা নই, পুরোটা পথ জুড়ে সবুজ পাহাড়, তারা যেন নিজেকে আবৃত করেছিল কুয়াশার নরম চাদরে। কুয়াশার ঘনত্ব ভেদ করে গাড়ি চালানো বেশ কষ্টকর হওয়ায় যাত্রাপথে প্রথম বিরতি বাঘাইহাট বাজারে।   






















পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এই পাহাড়ি বাজারের পাশ দিয়ে চলে গেছে কাচালং নদী। পাহাড়ি-বাঙালির দ্বন্দ্বের কারণে নদীর পাড়ের এই বাজার অনেকদিন ধরেই বন্ধ। বাজারে নেমেই এককাপ গরম চায়ে চুমুক, কুয়াশা আর শীতের সকালে কিছুটা উষ্ণতা। কিছুক্ষণের বিরতি শেষ করে আবার চলা শুরু। রাস্তার দুপাশের বিচ্ছিন্ন পাহাড়ি ঘর। বাঘাইহাট বাজারের পর গঙ্গারাম মুখ। দুপাশ থেকে বয়ে আসা দুটি নদী এক হয়েছে এখানে। পাহাড়ের বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া সর্পিল নদী চলে গেছে দূরের পথ ধরে। মুক্ত আকাশের নিচে বিশাল সমৃদ্ধ বনভূমির সন্ধান পাবেন কেবল সাজেক ভ্যালির পথে। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জুম চাষ, কয়েকরকমের জুম চাষে ভরপুর পাহাড়। 




উড়োবাজার, গঙ্গারামমুথ, নন্দরাম এসব পাহাড়ি পাড়া পেরিয়ে আমাদের দ্বিতীয় যাত্রা বিরতি মাচালং বাজার। পাশের সীমান্ত ঘেঁষা ভারত থেকে আসা মাচালং নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে ছোটখাট বাজার। এই এলাকা সাজেক ইউনিয়নের প্রধান কেন্দ্রস্থল। আদিবাসী আর বাঙালি— মিলেমিশে এই বাজারে ব্যবসা করে। সপ্তাহে দুইদিন, বৃহস্পতি এবং শুক্রবার এখানে বাজার বসে। দূরদূরান্তের পাহাড়িরা একদিন আগেই বাজারে আসতে শুরু করেন। জুমের ফসল বিক্রি করার আর্দশ স্থান এই মাচালং বাজার। মাচালং বাজার থেকে সাজেকের পথের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। বন্ধুর পথ— দুপাশেই আকাশচুম্বী পাহাড়ের বুকে উদ্ধত শিখর তুলে দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষরাজি। দীর্ঘজীবি বৃক্ষের দেখা মেলে এই পথে, মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন বসতি। দূরের পাহাড়ে মেঘের গড়াগড়ি দেখতে না দেখতেই আমরা পৌঁছে যাই সেই মেঘের রাজ্যে। এক সময় উঁচু পথের সমাপ্তি হয়, পা রাখি রুইলুই পাড়ায়। এটা সাজেক উপত্যকার মূল কেন্দ্র। রুইলুই পাড়ায় লুসাই, পাংখোয়া, ত্রিপুরা— জনগোষ্ঠীর বসবাস। পাড়ার সবগুলো বাড়ির রং লাল–সবুজ। রুইলুই পাড়ার নিচ থেকে প্রধান উপত্যকার অংশ শুরু। দীর্ঘ পথ শেষ করে বহুদূরে দাঁড়িয়ে আছে মিজোরামের প্রাচীন সুউচ্চ পাহাড়ের শ্রেণি। 
















রুইলুই পাড়া থেকে ২০ মিনিটের হাঁটা পথ কংলাক পাড়া। পাংখোয়াদের বসবাস এখানে। সব মিলিয়ে ১৫ পরিবারের বসবাস হবে। বিশাল পাথরখণ্ডের পাদদেশেই কংলাক পাড়ার অবস্থান। কংলাকের পাথরচূড়ায় দাঁড়িয়ে পুরো সাজেক উপত্যকা চমতকারভাবে এক নজরে দেখা যায়।
পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে এখানে আকাশ ঘুমায়, পাহাড়ের বন্ধনহীন মিলন দেখা যায়। কোথাও কোথাও তুলার মতো দলছুট মেঘের স্তুপ ভেসে বেড়ায় পাহাড়ের চূড়ায়, যেন স্বপ্নরাজ্য। দিনের শেষে কংলাক পাড়া থেকে রওনা হলাম সাজেক ভ্যালির পথে, রাতযাপন হবে রুইলুই পাড়ায়।
পূর্ণিমায় আলোয় আলোকিত পুরো পাড়া। সহস্র নক্ষত্রে ঢাকা সাজেকের বিস্তৃত আকাশ আর নক্ষত্রের আলোয় নিচের পৃথিবী, ধবধবে জোছনার আলোয় আলোকিত উপত্যকার পুরো রাজ্য।

জ্যোতস্না রাতের আলোয় কাছে দূরের পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জেগে উঠছে ঘন সাদা কুয়াশা। এমনই ঘন যে, কুয়াশাকে মনে হয় মেঘের ভেলা। এরকমই মেঘের ভেলায় ডুবে যাওয়া পাহাড়ের চূড়াকে মনে হচ্ছিল সমুদ্রের পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। বিভ্রম জাগে, এ কি আমাদের চেনা পৃথিবী!
ঘোরলাগা রাত এক সময় ভোর হয়, মেঘ পায়ের কাছে হেসে লুটোপুটি খায়- নতুন দিনের অভিবাদন জানায়। হলুদ নদী, সবুজ বন, গেরুয়া পাহাড় সবটুকু অদৃশ্য হয় সাদা মেঘের আড়ালে। মেঘ কেটে কেটে ফিরতে লাগলাম চেনা লোকালয়ের পথে। 





















যেভাবে যাবেন   
প্রথমে যেতে হবে খাগড়াছড়ি অথবা দিঘীনালা। রাজধানী থেকে শান্তি পরিবহন, বিআরটিসি (এসি বাস), সেন্ট মার্টিন (এসি বাস), শ্যামলী, সৌদিয়া, ঈগল, এস.আলম পরিবহনে খাগড়াছড়ি এবং দিঘীনালায় সরাসরি যাওয়া যায়। ভাড়া ৫৮০ টাকা (খাগড়াছড়ি), ৬শ’ টাকা (দিঘীনালা)।
চট্টগ্রাম থেকে প্রতি একঘণ্টা পরপর শান্তি পরিবহনের গাড়ি ছাড়ে, ভাড়া ১৯০ টাকা। তাছাড়া চট্টগ্রামের লোকাল বাসেও যাওয়া যায়।

খাগড়াছড়ি অথবা দিঘীনালা থেকে ভাড়ায় চাঁদের গাড়ি, ৩ হাজার ৫শ’ থেকে ৪ হাজার টাকা, সিএনজি ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা অথবা মোটরবাইক ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২শ’ রির্জাভ করে সাজেক ঘুরে আসতে পারবেন।
সাজেক যাওয়ার পথে বাঘাইহাট জোনে আপনার নাম, ঠিকানা এবং মোবাইল নম্বর এট্রি করতে হবে । 


যেখানে থাকবেন
সাজেক এলাকায় থাকার জায়গা নেই। তাই রাতে থাকার জায়গা আগে থেকেই ঠিক করতে হবে। দল বড় হলে প্রস্তুতি নিতে হবে আগে থেকেই।
থাকার জন্য আছে, রূনময় রির্সোট (বিজিবি পরিচালিত), সাজেক রির্সোট (সেনাবাহিনী পরিচালিত) আলোর রির্সোট এবং ক্লাব হাউস।
সাজেকবাসীদের পরিচালিত কয়েকটি দোকানে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে সেক্ষেত্রে আগেই তাদের জানাতে হবে।

প্রয়োজনীয় তথ্য
সাজেক অনেক দুর্গম জায়গা। এখানে বিদ্যুত সংযোগ নেই। যাও আছে তা মূলত সৌর বিদ্যুত নির্ভর। উঁচু জায়গা বলে পানীয় জলের সংকট আছে। তাই খাওয়ার পানি সঙ্গে নেওয়া উচিত।

খেয়াল করবেন
সর্ব‍প্রথমে মনে রাখতে হবে " পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ " ।   মানুষ প্রকৃতির কাছে যাবে, তবে প্রকৃতি যাতে তার মতো করে সুন্দর থাকে সেই দায়িত্বটাও মানুষের হাতে। আপনার ব্যবহার কোন প্রকার পলিথিন, পানির বোতল, প্যাকেট, ময়লা ইত্যাদি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবেন। না হলে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন।  






বাংলাদেশকে জানুন,অন্যকে জানান। বেড়িয়ে আসুন সময় করে,অবশ্যই ভালো লাগবে আশা করি। ধন্যবাদ সবাইকে।