সোমবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৫

বর্ষায় আরো সুন্দরী সুন্দরবন।




পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’ বা শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন৷ এই বনের প্রধান গাছটির নাম সুন্দরী৷ আর তার থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ৷ ঋতুতে ঋতুতে এ বনের চরিত্র বদলায়৷ তবে সুন্দরবন সবচেয়ে বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বর্ষাকালে৷
‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দিলাম মেপে’
বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে সুন্দরবনে বর্ষা আসে মে মাসে আর সেই বর্ষাকাল চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত৷ অবশ্য জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগ পর্যন্ত এখানে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়৷ সুন্দরবন অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৬৪০-২০০০ মিমি৷ তবে বনের পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে বৃষ্টিপাত তুলনামূলকভাবে বেশি৷


দিনে দু’বার জোয়ার-ভাটা
প্রতিদিন দু’বার করে জোয়ার-ভাটা হয় সুন্দরবনে, যা কিনা বাংলাদেশ ও ভারত – প্রতিবেশী এই দুই দেশের বিশাল উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত৷ এখানে সবচেয়ে বড় জোয়ার হয় পূর্ণিমা ও অমাবস্যায়৷ তবে বর্ষাকালে জোয়ারের উচ্চতা থাকে সবচেয়ে বেশি৷ এ সময় বনের বেশিরভাগ অংশই প্লাবিত হয়, ডুবে যায় সবকিছু৷
খাবারের সন্ধানে হরিণশাবক
জোয়ারের পানিতে সুন্দরবন প্লাবিত হলে হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীরা অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গাগুলোয় আশ্রয় নেয়৷ এরপর জোয়ারের পানি নেমে গেলে খাবারের সন্ধানে নেমে পড়ে তারা৷ আর ঠিক সেই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন বহু পর্যটক – বন্যপ্রাণী দেখবেন বলে৷

তারপরেও পরিত্যক্ত বহু এলাকা
বর্ষা মৌসুমে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের একটি পর্যটক ট্রেল৷ এ সময়ে পর্যটকের যাতায়াত না থাকায় এই হাঁটা পথের ওপরে জমা হয়েছে বিভিন্ন গাছের ফল৷ আসলে ম্যানগ্রোভ অরণ্য হলেও, বেশ কিছু ফল গাছও আছে সুন্দরবনে৷

সুন্দরী বন সুন্দরবন
জোয়ারের পানিতে সুন্দরবনের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ভেসে আসে এ বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী গাছের ফল৷ ভেসে যায় আশেপাশের কোনো এলাকায়৷ তবে সুন্দরী গাছের বন সুন্দরবনে এমন একটা দৃশ্যের দেখা পাওয়া যায় কেবলমাত্র বর্ষাকালে৷
জঙ্গলের বিস্তার, সুন্দরেরও
জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা সুন্দরী ফলের অংশ বিশেষ ভাটার সময় জঙ্গলে থেকে যায়৷ তারপর সেখান থেকেই অঙ্কুর গজায়, গাছ হয়, ফুল ফোটে, ফল দরে৷ এভাবেই বিস্তার ঘটে সুন্দরী গাছ এবং তার সাথে সাথে সুন্দরবনের৷ প্রকৃতির এ নিয়মেই বেড়ে উঠেছে সুন্দরবনের বেশিরভাগ বনাঞ্চল৷


সুন্দরবনের বানর
সুন্দরবনের অন্যতম বাসিন্দা বানর৷ ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় এই বনে বেড়াতে গেলে তাই এদের চোখে পড়বেই৷ কখনো একা একা, আবার কখনো দঙ্গল বেধে ঘুরে বেড়ায় এরা৷ তবে বৃষ্টির সময় এদের গাছের ডালেই আশ্রয় নিতে দেখা যায়৷
চলে লুকোচুরির খেলা...
বর্ষাকালে সুন্দরবনে চলে রোদ আর বৃষ্টির লুকোচুরি৷ ঝকঝকে রোদের মধ্যে হঠাৎ করেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখা যায় এখানে৷ গাড় হয়ে ওঠে নদীর পানি, বনের সবুজে পড়ে ছায়া৷ কখনো কখনো মেঘের ভেতর থেকেই সূর্য উঁকি মারে, অসাধারণ দৃশ্যের অবতারণা হয় বনজুড়ে৷ 

‘লাল-নীল-সবুজের মেলা বসেছে’
কখনো আবার তুমুল বৃষ্টিপাতের মধ্যে হঠাৎ করেই ঝকঝকে নীলাকাশ দেখা যায় সুন্দরবনে৷ বৃষ্টিধৌত বনে সূর্যের আলো তখন ভিন্ন পরিবেশের সৃষ্টি করে৷ ঝলমল করে ওঠে নদী, বনের গাছ৷ বৃষ্টি একটু ধরলে আস্তে আস্তে নদীর ধারে চড়তে আসে বানর, হরিণ, এমনকি বাঘ মামাও৷
বর্ষার এক ভিন্ন চিত্র
সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া বন্যপ্রাণী অভয়রাণ্যে বৃষ্টিস্নাত এক ‘গ্রেটার ইয়োলোনেইপ’ বা বড় হলদেসিঁথি কাঠঠোকরা৷ নানা রকম পাখির নিরাপদ আবাসস্থল এই সুন্দরবন৷ প্রায় ৪০০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি রয়েছে সুন্দরী গাছের এ বনে৷

সুন্দরবনের সুন্দরী হাঁস
সুন্দরবনের কটকা বনাঞ্চলের বড় কটকার খালে চোখে পড়ে ‘মাস্কড ফিনফুট’ বা সুন্দরী হাঁস৷ এর আরেক নাম কালোমুখ প্যারা পাখি৷ বাংলাদেশের সুন্দরবন ও মিয়ানমারে এ হাঁসের বিচরণ সবচেয়ে বেশি৷ সারা পৃথিবীতে বর্তমানে এ পাখির সংখ্যা এক হাজারেরও কম৷ লাজুক স্বভাবের সুন্দরী হাঁসের বৃহত্তম আবাসস্থলও সুন্দরবন৷


জেলেদের জীবন
সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী জয়মনি জেলে পল্লীর পাশে পশুর নদীতে চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করছেন জেলেরা৷ সুন্দরবনের পাশে গড়ে ওঠা ভ্রাম্যমাণ এ জেলে পল্লীর জেলেরা সুন্দরবন ও তার আশেপাশে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন৷   



চা কন্যা, শ্রীমঙ্গল।




মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে জেলায় প্রবেশদ্বারে অনিন্দ্য সুন্দর ভাস্কর্য ‘চা কন্যা’। সাতগাঁও চা বাগানের সহায়তায় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন ২০১০ সালে নির্মাণ করে এই ভাস্কর্য। শ্রীমঙ্গলের চা বাগানগুলো ভ্রমণের জন্য উৎকৃষ্ট। সবুজে ভরপুর চা বাগানে বেড়ানোর আসল সময় এখনই। এসেছে শরৎ। তবে চা বাগানের বর্ষা এখনো শেষ হয়নি। মে মাস থেকে শুরু হওয়া পাতা তোলার মৌসুম এখনো চলছে চা বাগানগুলোতে। চলবে অক্টোবরের শেষ অবধি। সাদা ধবধবে এক নারী, পিঠে ঝোলানো ঝুড়ি, কোমল হাতে তুলে চলছেন চা পাতা। ঢাকা-শ্রীমঙ্গল মহাসড়কে রশিদপুর ছাড়িয়ে একটু সামনে গেলেই এক বাঁকে এই চা কন্যার দেখা মেলে। সাতগাঁও চা বাগানের সহায়তা নিয়ে দৃষ্টিনন্দন এই ভাস্কয তৈরি করেছে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন। এর নাম ‘চা কন্যা’। হবিগঞ্জ জেলার শেষপ্রান্তে ও মৌলভীবাজার জেলায় প্রবশদ্বারে প্রায় ২৪ ফুট উঁচু ভাস্কর্যটি সব পর্যটককে যেনো স্বাগত জানাতেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। ২০১০ সালের শুরুতে এ ভাস্কর্য নির্মাণ করেন শিল্পী সঞ্জিত রায়। ‘চা কন্যা’ ভাস্কর্যের পাশেই সাতগাঁও চা বাগান। পাহাড়ের গায়ে গায়ে এ চা বাগানের সৌন্দর্য অপূর্ব। চা কন্যাকে দেখে ঢুঁ মারতে পারেন এই বাগানেও। তারপর সোজা চলে যেতে পারেন শ্রীমঙ্গল শহরে। শহরের মৌলভীবাজার সড়ক ছেড়ে হাতের ডানে ভানুগাছ সড়ক। এ পথে কিছুটা সামনে এগোলেই সড়কের দুই পাশে মিলবে চা বাগান আর চা বাগান। এগুলো ফিনলে কোম্পানীর চা বাগান। সড়কের পাশে গাড়ি থামিয়ে কিছুটা সময় কাটাতে পারেন। একই পথে আরো সামান্য সামনে গেলে হাতের বাঁয়ে চা বাগানের ভেতর থেকে একটি পাকা সড়ক সোজা দক্ষিণে চা গবেষণা কেন্দ্রের দিকে চলে গেছে। এ সড়কের আরেকটু ভেতরে গেলে মাইলের পর মাইল ফিনলের চা বাগান। 


শ্রীমঙ্গল গ্রান্ড সুলতান টি রিসোর্ট


এই বাগান ঘুরে আবারো চলে আসুন ভানুগাছ সড়কে। চলতে থাকুন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের দিকে। এ পথে প্রায় ১২ কিলোমিটার সামনে এগিয়ে গেলে কমলগঞ্জ শহর। সেখান থেকে আবারো হাতের বাঁয়ের সড়কে কয়েক কিলোমিটার গেলে মাধবপুর লেক। এখানে বিশাল এক হ্রদ ঘিরে আছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টি কোম্পানীর চা বাগান। মাধবপুর লেকের আশেপাশের এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এ বাগানের সৌন্দর্য একেবারেই আলাদা। একটু সময় নিয়ে ঘুরতে পারেন। মাধবপুর লেকের দক্ষিণ পাশের পাহাড়েও আছে চা বাগান। এ পাহাড়ে উঠে দেখে নিতে পারেন লেকের অন্যরকম সৌন্দর্য। মাধবপুর লেক থেকে বেরিয়ে হাতের বাঁয়ে পিচঢালা পথে চলুন এবার। আঁকাবাঁকা এ পথ চলে গেছে একেবারে ধলই সীমান্তে। পথের দুই পাশে শুধুই চা বাগান। তবে এ পথের সম্ভবত সবেচেয়ে সুন্দরতম 
বাগানের নাম ‘শ্রীগোবিন্দপুর’। বেসরকারি মালিকানাধীন এ চা বাগান একেবারেই ছবির মতো সাজানো বলা চলে। আরো দক্ষিণে গেলে বাংলাদেশ সীমান্ত। আর সীমান্ত ঘেঁষেই আছে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ। এখানে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন দেশের শ্রেষ্ঠ এ সন্তানের প্রতি। এবার একটু পেছনে এসে ইট বাঁধানো একটি পথ চলে গেছে হাতের বাঁয়ে। এ পথে চলতে প্রথমে ভয় লাগতে পারে। একেবারেই নির্জন চারপাশ। চলতে চলতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। এটিই ধলই চা বাগান। চলতে থাকুন এ পথে। চা বাগান দেখতে দেখতে একসময় চলে আসবেন আবারও ফিনলে চা বাগানে। একেবারে শ্রীমঙ্গল শহরের পাশেই। 


লাউয়াছড়া উদ্যানে



চা বাগান ভ্রমণ শেষে ঢুঁ দিতে পারেন ঐতিহ্যবাহী নীলকণ্ঠ কেবিনে। সাত রঙের চা ছাড়াও নানান বাহারি চা পাওয়া যায় এখানে। শ্রীমঙ্গল শহরের অনেক জায়গায় সাতরঙা চা পাওয়া গেলেও বিজিবি দফতরের পাশেই হলো আসল নীলকণ্ঠ কেবিন।
যেভাবে যাবেন : 
শ্রীমঙ্গলের এ চা বাগানগুলো ভালোভাবে ভ্রমণের জন্য নিজস্ব গাড়ি নিয়ে গেলে ভ্রমণ সহজ হবে। তবে ঢাকা থেকে বাসে কিংবা ট্রেনে শ্রীমঙ্গল পৌঁছে সেখান থেকেও গাড়ি ভাড়া করে চা বাগানে বেড়াতে পারেন। ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়েদাবাদ থেকে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, সিলেট এক্সপ্রেস ইত্যাদি পরিবহনের নন এসি বাস যায় শ্রীমঙ্গল। ভাড়া ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। এছাড়া ঢাকার কমলাপুর থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্ত:নগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। দুপুর ২.০০ মিনিটে প্রতিদিন ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস।
বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ১০টায় ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস এবং শুক্রবার ব্যতীত সপ্তাহের প্রতিদিন বিকেল ৪টায় ছাড়ে কালনি এক্সপ্রেস। ভাড়া ১১৫ থেকে ৭৬৫ টাকা।
রেলপথে সাধারণত ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। এছাড়া চট্টগ্রাম রেলপথেও সরাসরি শ্রীমঙ্গল যাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় আন্ত:নগর পাহাড়িকা এক্সপ্রেস এবং শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯টায় মিনিটে ছেড়ে যায় আন্ত:নগর উদয়ন এক্সপ্রেস। ভাড়া ২৩০ থেকে ৯৪৩ টাকা।
অবকাশ যাপন করবেন যেখানে :
শ্রীমঙ্গলে পর্যটকদের থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা ভানুগাছ সড়কে অবস্থিত টি রিসোর্ট (০৮৬২৬-৭১২০৭, ০১৭১২-৯১৬০০১)। এছাড়া এই রাস্তায় আছে আন্তর্জাতিক মানের গ্র্যান্ড সুলতান গলফ এ- টি রিসোর্ট। পাঁচ তারকা মানের এ রিসোর্ট বেশ ব্যয়বহুল (০২-৯৮৫৮৮২৭, ০১৭৩০-৭৯৩৫৫২-৭)। শ্রীমঙ্গলে অন্যান্য থাকার জায়গা হচ্ছে-হবিগঞ্জ সড়কে রেইন ফরেস্ট রিসোর্ট (০২-৯৫৫৩৫৭০, ০১৯৩৮৩০৫৭০৭) ও টি টাউন রেস্ট হাউস (০৮৬২৬-৭১০৬৫)। কলেজ রোডে হোটেল প্লাজা (০৮৬২৬-৭১৫২৫) ইত্যাদি। এছাড়া শ্রীমঙ্গলের রাধানগরে চমৎকার দু’টি রিসোর্ট হচ্ছে নিসর্গ নিরব ইকো রিসোর্ট (০১৭১৫০৪১২০৭) এবং নিসর্গ লিচিবাড়ি ইকো রির্সোট (০১৭১৬-৯৩৯৫৪০)।
প্রয়োজনীয় তথ্য:
শ্রীমঙ্গলের চা বাগানগুলো বেড়ানোর জন্য একদিনই যথেষ্ঠ। যেকোনো চা বাগানে প্রবেশের আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিন। চা শ্রমিকদের ছবি তোলার আগেও অনুমতি নিন।

শনিবার, ১ আগস্ট, ২০১৫

শ্রীমঙ্গল গিয়ে যা দেখবেন।

শ্রীমঙ্গল গিয়ে যা দেখবেন। 

এ দেশে `চায়ের রাজধানী’র কথা বললেই প্রথমে মনে পড়বে শ্রীমঙ্গলের নাম। পাহাড়ি এই এলাকায় মাইলের পর মাইল চা বাগান। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত মানের চায়ের একটি অংশ এই বাগানগুলো থেকেই পাওয়া যায় এবং বিদেশে রপ্তানী হয়। এখানে চা বাগানের পাশাপাশি রয়েছে রাবার, লেবু ও আনারসের বাগান। বাংলাদেশের লেবুর চাহিদার বড় যোগান আসে শ্রীমঙ্গল থেকে। সবুজ প্রকৃতির মায়াবি  রূপের কারণে শ্রীমঙ্গলের রয়েছে আলাদা পরিচিতি। শুধু দেশে নয়, বিদেশের পর্যটনপিপাসুদের কাছেও এই জায়গাটির কদর রয়েছে। ফলে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে শ্রীমঙ্গলের অবস্থান প্রথম সারিতে। তাছাড়া রাজধানী  ঢাকার কাছাকাছি এত অপূর্ব কোনো পর্যটন কেন্দ্র নেই। সুতরাং মুক্ত প্রকৃতি এবং নির্মল হাওয়ার জন্য শ্রীমঙ্গল হতে পারে আপনার প্রথম পছন্দ। 
লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে রেল লাইন  

লাউয়াছড়া বন : বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এই বন শ্রীমঙ্গল শহর থেকে আট কি.মি. পূর্বে অবস্থিত। সড়ক পথে শহরে যেতে বনের মাঝ দিয়েই যেতে হয়। সবুজ অরণ্যে ঢাকা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে লিকলিকে সড়ক অনায়াসেই পৌঁছে দেয় শহরে। বনের ভেতর ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে একাধিক প্রশস্ত ট্রেইল। ট্রেইল ধরে সামান্য এগুলেই পাখির কিচিরমিচির প্রাণ ভরে উপভোগ করবেন। এখানে ২৬০ বা তারও অধিক প্রজাতির পাখিসহ বিভিন্ন প্রজাতির সরিসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। হরিণ, বন মোরগ, কাঠবিড়ালি, অজগর, গিবন (দীর্ঘদেহী বানর), চশমা বানর, হুনুমানসহ রয়েছে আরো অনেক প্রাণী। বনের মাঝে ঘন গাছপালায় আচ্ছাদিত কিছু জায়গা রয়েছে। জনশ্রুতি মতে সেই জায়গায় নাকি বাঘও রয়েছে! এখানকার অন্যতম সৌন্দর্য হলো ঢাকা-সিলেট রেল পথ। বনের দীর্ঘ অংশের মাঝ দিয়ে এগিয়ে গেছে এই রেল পথ। পথটি ধরে ইচ্ছে মত খানিকক্ষণ হাঁটুন এবং গেয়ে উঠুন সেই গানটি, বিশেষ কোনো মুহূর্তে যে গানের দু-চার লাইন আপনার মুখ দিয়ে এমনিতেই বেরিয়ে আসে। 

মাধবকুণ্ড ঝরনা : বাংলাদেশের উচ্চতম ঝরনা এটি। প্রায় দুইশ ফুট উঁচু থেকে প্রবল বেগে অনর্গল পানি ঝরে। পানির প্রচণ্ড গতির কারণে নিচে সৃষ্টি হয়েছে একটি পুকুর। পর্যটকদের কেউ কেউ আনন্দে আত্মহারা হয়ে নেমে পড়েন পুকুরের হিমশীতল জলে। দেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ঝরনা মাধবকুণ্ড দেখতে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটক আসেন। 

পরীকুণ্ড ঝরনা : সচরাচর লক্ষ করা যায় দর্শনার্থীরা কেবল মাধবকুণ্ড ঝরনা দর্শন করেই ফিরে আসে। তাদের বেশির ভাগেরই জানা নেই মাধবকুণ্ডের নিকটেই রয়েছে পরীকুণ্ড নামে দৃষ্টিনন্দন আরো একটি ঝরনা। মাধবকুণ্ড যেতে পায়ে হাঁটা পথের মাঝামাঝি গিয়ে ডান দিকে নেমে গেছে আর একটি পথ। পথটি ধরে নামলেই ছরা, তারপর ছরা ধরে হাঁটতে হবে বিশ থেকে পঁচিশ মিনিটের মত। দেখবেন আপনার সামনেই ঝরছে পরীকুণ্ডের অনর্গল ধারা। মাধবকুণ্ড ও পরীকুণ্ড যাওয়ার পথে দুপাশে উঁচু-নিচু পাহড় ও টিলাগুলো দেখবেন চা গাছে আবৃত। আঁকাবাঁকা সে পথের প্রেমে পড়েন না এমন দর্শনার্থী মেলা ভার। 

হাকালুকি হাওর : ১৯২ বর্গ কি.মি. আয়তনের বিশাল জলরাশি- হাকালুকি হাওর। শ্রীমঙ্গল থেকে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। এখানকার সাধারণ প্রকৃতি অসাধারণ এক বিষয়। তার ওপর বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এই হাওরে বসে অতিথি পাখির মেলা। দেশের সীমানার বাইরে দূর দূরান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ অতিথি পাখি এখানে এসে টানা কয়েক মাসের জন্য অস্থায়ী নিবাস গড়ে তোলে। পাখির কলরবে মুখোর হয়ে যায় হাকালুকির প্রকৃতি। হাওরের বুকে জমে ওঠা পাখির কলতান উপভোগ করতে শত শত পর্যটক ভিড় জমান শীতের সময়। এই বর্ষায় হাওরের আবার অন্য রূপ দেখা যায়।   

                                  সাত রঙের চায়ে মুগ্ধ এই দুই পর্যটক
শীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা :  ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা দেশের একমাত্র চিড়িয়াখানা শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত। শীতেশ নামক স্থানীয় এক প্রকৃতিপ্রেমী একেবারেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন এই মিনি চিড়িয়াখানা। দিনে দিনে তার সংগ্রহে যুক্ত হয়েছে অনেক প্রজাতির পশুপাখি। সাদা বাঘ, মুখপোড়া বানর, সজারু, হরিণ, উল্লুক, ধনেশ পাখি, একাধিক প্রজাতির কাঠবিড়ালি এর অন্যতম। শ্রীমঙ্গল রেল স্টেশন থেকে চিড়িয়াখানায় পৌঁছতে পনেরো টাকা রিকশা ভাড়া লাগে। ভেতরে প্রবেশ করতে দশ টাকার টিকিট কাটতে হয়। 

ক্ষুদ্র জাতিসত্তা পল্লী :  দেশের চা বাগানের প্রায় নব্বই শতাংশ শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত। এই বাগানের শ্রমিকরা প্রায় সকলেই মণিপুরী এবং খাঁসি (খাঁসিয়া) জাতিসত্তার অধিকারী। সেই ইংরেজ আমলে যখন চা চাষের শুরু, তখন থেকে আজ পর্যন্ত শ্রমিক বলতে তারাই। যুগে যুগে ঘটেছে তাদের বংশ বিস্তার। বর্তমানে তারা স্থানীয় জনসংখ্যার মোটামুটি একটি অংশ হয়ে উঠেছে। আপন সংস্কৃতিতে বৈচিত্রময় তাদের জীবন। অনাদীকালের সংস্কৃতি ধরে রেখেছে তারা হৃদয়ে। এটা তারা পালনও করে যা আমাদের জন্য দেখার মত একটি বিষয় হয়ে ওঠে। পর্যটকেরা চাইলেই ঘুরে দেখতে পারেন তাদের পল্লী বা বসতি। 

সাত রং চা :  চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল গেলেন অথচ সাত রং চায়ের স্বাদ গ্রহণ করলেন না, তা হয় না। একই গ্লাসের মধ্যে স্তরে স্তরে সাজানো সাত রং এর চা! চা ভর্তি গ্লাসটি যখন আপনার সামনে পরিবেশিত হবে হয়তো বিস্মিত হয়ে ভাববেন, তরল পানীয়কে কীভাবে সাতটি স্তরে সাজানো সম্ভব! ব্যাপারটি বিস্ময়েরই বটে। অর্ডার করলে গোপন ঘরে প্রস্তুত করার পর সেই চা আপনাকে পরিবেশন করা হবে। প্রতি গ্লাসের মূল্য ৭০-৯০ টাকা। 

                              হাকালুকি হাওর একেক সময় একেক রূপ তার  
টি এস্টেট : পর্যটকেরা চাইলে শ্রীমঙ্গলের চা কারখানাও ঘুরে দেখতে পারেন। টি রিসার্স ইনস্টিটিউট হতে পারে পরিদর্শনের অন্যতম একটি জায়গা। দেখতে পাবেন চা প্রস্তুত প্রণালী। বাগানের ভেতর শ্রমিকদের সঙ্গে খানিকটা সময়ও কাটানো যেতে পারে। শ্রীমঙ্গলে থাকার জায়গা হিসেবে টি রিসার্স ইনস্টিটিউটের ‘টি রিসোর্ট’ অত্যান্ত চমৎকার একটি জায়গা। টিলার উপর বিশাল জায়গা নিয়ে নির্মিত রিসোর্টে রয়েছে দশ-বারোটি কটেজ। বৃক্ষের ছায়া তলে অনেক দূরে দূরে একেকটি কটেজ। বড়সর রেস্তোরাঁর সঙ্গে রয়েছে পুরনো আমলের সুইমিংপুল। পাশেই নেট দিয়ে ঘেরা জায়গার মধ্যে চরে বেড়ায় বেশ ককেটি চিত্রল হরিণ। কেবল রিসোর্ট সীমানার মাঝে অবস্থান করে ও আশপাশের চা বাগান দেখেই কাটিয়ে দেয়া সম্ভব দু’দিন দিন। 

মাধবপুর লেক :  কোন কালে সৃষ্টি হয়েছে এই লেকের তা কেউ বলতে পারে না। সমতল থেকে উঁচুতে পাহাড়ে লেকটির অবস্থান। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ খুব সুন্দর। সময় করে লেকের চারপাশ প্রদক্ষিণ করতে পারলে নিঃসন্দেহে তা হবে এক দারুণ অভিজ্ঞতা।

চাইলে নিজ ব্যবস্থাপনাতেই শ্রীমঙ্গল ও তার আশপাশের এলাকা ভ্রমণ করা সম্ভব। ঢাকা থেকে ট্রেনে যাওয়া সবচেয়ে নিরাপদ ও আরামদায়ক। জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, পারাবত এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস এবং সুরমা মেইল কমলাপুর থেকে সিলেট নিয়মিত যাতায়াত করে। আপনাকে নামতে হবে শ্রীমঙ্গল স্টেশনে। এ ছাড়াও  ঢাকা সায়দাবাদ, মহাখালী ও ফকিরাপুল থেকে সারাদিনই বাস সার্ভিস রয়েছে। শ্যামলী, সোহাগ পরিবহণ, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, সৌদিয়া এই রুটের অন্যতম বাস। শ্যামলী পরিবহণ-০২-৭৫৪০৯৯৩,০২৭৫৫০০৭১। সোহাগ পরিবহণ-০২-৯৩৪৪৪৭৭, ০১৭১১-৬১২৪৩৩। সৌদিয়া -০১৯১৯-৬৫৪৮৫৮,০১৯১৯-৬৫৪৮৬১।  
                      শ্রীমঙ্গলের একটি চা বাগানে নারী শ্রমিক চায়ের পাতা সংগ্রহ করছেন  
থাকার জন্য রয়েছে টি রিসোর্ট। ফোন-০১৭১২-৯১৬০০১। হোটেল প্লাজা-৮৬২৬৫২৫, ০১৭১১-৩৩২৬০৫। রেইন ফরেস্ট রিসোর্ট-০১৯৩৮-৩০৫৭০৬। হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান (পাঁচ তারকা)-০১৫৫২-৬৮৩৪৫৪।

শ্রীমঙ্গল, সিলেট ভ্রমণে টুর অপারেটরদের বছরজুড়েই অফার থাকে। ৭,৮০০ থেকে ৮,৫০০ টাকায় তাদের মাধ্যমে শ্রীমঙ্গল ঘুরে আসা সম্ভব। কোনো কোনো অপারেটর প্যাকেজে সিলেটসহ শ্রীমঙ্গল ভ্রমণের অফার দিয়ে থাকে। যোগাযোগ করতে পারেন এদের সঙ্গে :
সাউথ এশিয়ান টুরিজম, ফোন : ০১৭১৬-৪৬৬০৪৭। সাবরিনা ট্রাভেলস অ্যান্ড টুরস্, ফোন : ০১৭৭৪৭৫৫১৩১। গ্রীন বাংলাদেশ টুরস, ফোন : ০২-৮৬৫২২৫৪, ০১৮১৯-৪৮০৫৪০। দ্য গাইড টুরস লিমিটেড, ফোন : ০২-৯৮৮৬৯৮৩, ০১৭১১-৬৯৬৩৩৭। ক্যাপ্টেইন হলিডেজ,  ফোন : ০১৯৭৭০৫৮৪৫২। লেজার টুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস লি. ফোন : ০২-৯৩৪৮৭০৬, ০১৭১২-১১১১১১।   


আসছে শীত মৌসুমে বেড়ানোর প্রস্তুতি নিয়ে নিন। অবশ্যই ভালো সময় কাটবে শ্রীমঙ্গলে। ধন্যবাদ সবাইকে।