আমাদের ঐতিহ্য: আর্মেনিয়ান চার্চ ।
ঢাকার যে সব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে আর্মেনিয়ান গির্জা তাদের মধ্যে অন্যতম। পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় আর্মেনিয়ান গির্জাটি ‘আর্মেনিয়ান চার্চ’(Armenian Church) নামে পরিচিত। এটি নির্মিত হয় ১৭৯১ সালে। গির্জা নির্মাণের আগে তাদের ছোট একটি উপাসনাগার ছিল। ঐতিহ্যবাহী এই গির্জার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঢাকার আর্মেনীয়দের ইতিহাস।
আর্মেনিয়ান চার্চ বা গির্জাটি আর সব গির্জা থেকে আলাদা। প্রতিটি গির্জার কবর বা সমাধিস্থল আলাদা কিন্তু আর্মেনিয়ান গির্জা পুরোটাই যেন সমাধিস্থল। আর সেসব সমাধি দামি মার্বেল পাথর দিয়ে গড়া। এখন যে জায়গায় গির্জাটি দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে ১৭৮১ সালে ছিল আর্মেনীয়দের সমাধিস্থল।
দুইশত বছরের পুরানো এই ঐতিহ্যময় গীর্জাটির রক্ষণাবেক্ষণ এখনো অবশিষ্ট আর্মেনীয় পরিবারই করে থাকেন।
লোকশ্রুতি অনুযায়ী গীর্জাটি নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন চারজন আর্মেনীয়। এরা হলেন মাইকেল সার্কিস, অকোটাভাটা সেতুর সিভর্গ, আগা এমনিয়াস এবং মার্কার পোগজ।

ভৌগোলিকভাবে আর্মেনিয়ার অবস্থান দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে। রাজধানীর নাম ইরেভান। আর্মেনিয়ার মাঝখানে অবস্থিত একটা হ্রদ; নাম সেভান।
আর্মেনীয়রা কবে ঢাকায় এসেছিলেন তা জানা না গেলেও ধারণা করা হয় মুঘল আমলে ভাগ্য বদলাতে দেশ-বিদেশ থেকে যখন অনেকেই আসতে শুরু করেন; সম্ভাব্য সপ্তদশ শতকে আর্মেনীয়রাও তখন দু’একজন করে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন এ অঞ্চলে। সেই থেকে এই অঞ্চল আরমানিটোলা নামে পরিচিত।
উনিশ শতকের ঢাকায় পরিচিত ও প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে যে ক’টি আর্মেনীয় পরিবারের নাম পাওয়া যায় সেগুলো হলো- পোগস, আরাতুন, পানিয়াটি, স্টিফান, লুকাস, কোজা মাইকেল, মানুক, হার্নি, সিরকোর এবং সার্কিস।
অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের প্রথমার্ধে অতিক্ষুদ্র একটি সম্প্রদায় হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা শহরে আর্মেনীয়রা ছিলো যথেষ্ট প্রভাবশালী। এর কারণ, তাদের ছিলো বিত্ত। অষ্টাদশ শতকে লবণ ছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা। লবণ উৎপাদন ও বিতরণের জন্য কোম্পানি ঠিকাদার নিয়োগ করতো। পূর্ববঙ্গে লবণের ঠিকাদারদের অধিকাংশই ছিলেন আর্মেনীয়রা। ঠিকাদারি ছাড়াও পান, পাট ও কাপড়ের ব্যবসায় ছিলো তাদের কর্তৃত্ব। জমিদারীও ছিলো অনেকের।
এদের বিত্তের ভিত্তি ছিলো জমিদারি ও ব্যবসা। বিদেশি হয়েও জমিদারি কেনার কারণ হতে পারে- আভিজাত্য অর্জন এবং সমাজের শীর্ষে থাকা। এসব ধনী আর্মেনীয়ানরা ঢাকায় নিজেদের থাকার জন্য তৈরি করেছিলেন প্রাসাদতুল্য সব বাড়ি। যেমন ফরাসগঞ্জের বর্তমান রূপলাল হাউস ছিলো আরাতুনের। মানুক থাকতেন সদরঘাটে। বর্তমানে ‘বাফা’ যে বাড়িতে, সেটি ছিলো নিকি পোগজের। পরে আরমানিটোলায় নির্মিত হয়েছিলো ‘নিকি সাহেবের কুঠি’। আনন্দরায় স্ট্রিটে ছিলো স্টিফানের বাড়ি। তাজমহল সিনেমা যেখানে রয়েছে সেখানে ছিলো পানিয়াটির অট্টালিকা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি অনেক আর্মেনীয় ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়েন। ব্যবসাগুলো হচ্ছে চা, মদ, ইউরোপীয় জিনিসপত্র, ব্যাংক ইত্যাদি। ১৮৫৬ সালে সিরকোরই ঢাকায় প্রথম ঘোড়ার গাড়ি চালু করেন, যা পরিচিত ছিলো ‘ঠিকা গাড়ি’ নামে। কিছুদিনের মধ্যেই এই ব্যবসা বেশ জমে উঠে এবং কালক্রমে তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ঢাকার প্রধান যানবাহন।
ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুর দিক থেকেই ঢাকায় আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমতে থাকে। বর্তমানে ঢাকায় আঠারোটি আর্মেনীয় বংশদ্ভূত পরিবার রয়েছে বলে শোনা যায়। তবে কখনই ঢাকায় আর্মেনীয়দের সংখ্যা খুব একটা বেশি ছিলো না।

গীর্জাটি লম্বায় সাড়ে সাতশো ফুট, দরজা চারটি, জানালা সাতটি। এর পাশেই ছিলো একটি ঘড়িঘর। এটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন জোহান্স কারু পিয়েত সার্কিস। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ঘড়িঘরটি ভেঙে গিয়েছিলো বলে জানা যায়। গীর্জায় বৃহৎ আকারের একটি ঘণ্টা ছিলো। ১৮৮০ সালের দিকে আর্মেনিয়ান গীর্জার এই বিখ্যাত ঘণ্টাটি স্তব্ধ হয়ে যায়, যা আর কখনো বাজেনি। এই ঘণ্টা বাজার শব্দ নগরের প্রায় সব স্থান থেকে সবাই শুনতে পেত বলে সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এই ঘণ্টার শব্দ শুনেই নাকি অধিকাংশ ঢাকাবাসী নিজ নিজ সময়ঘড়ি ঠিক করে নিতেন। মৃত্যুর পর ঢাকার আর্মেনীয়দের কবর দেয়া হতো আর্মেনীয় গীর্জার প্রাঙ্গণে। প্রাঙ্গণের পরিসর ছোট হওয়ার কারণে গীর্জাটির গোটা প্রাঙ্গণ এমনকি বারান্দার মেঝেতেও প্রচুর সমাধিফলক চোখে পড়ে। অধিকাংশ স্মৃতিফলকে উদ্ধৃত রয়েছে ধর্মগ্রন্থের বাণী।
পুরো চার্চ ঘিরে আছে কবর আর কবর। সবগুলো কবরই শ্বেতপাথরসহ বিভিন্ন মূল্যবান পাথর দিয়ে বাঁধাই করা। তাছাড়া মৃত ব্যক্তির নামসহ ফুল-পাখির বিভিন্ন নকশা করা এবং আবেগ ঢেলে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে প্রতিটি কবরের গায়ে কাব্যময় কিছু লেখা ।
কীভাবে যেতে হবে?
রাজধানী ঢাকার যে-কোন স্থান হতে প্রাইভেট গাড়ি, রিকশা বা সি এন জি তে করে পুরানো ঢাকার আর্মানিটোলাতে আসা যাবে।
=================