শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৪

ভ্রমণ :: কুটিবাড়ি, মাদারীপুর।

ডানলপ সাহেবের নীলকুঠি


সাধারন মানুষের কাছে পরিচিত ডান লপ সাহেবের নীল কুঠি নামে। গরীব চাষীদের  উপর ব্রিটিশ নীলকরদেও অত্যাচার ও ঐতিহাসিক ফরায়েজী। আন্দোলন এর নীরব সাক্ষী নীলকুঠি এখন ও এটি দাঁড়িয়ে আছে। মাদারীপুর জেলা শহর থেকে ১০ কিঃমিঃ উওর- পূর্ব দিকে সদর উপজেলার ছিলারচর  ইউনিয়নের  আউলিয়াপুর গ্রামে এই নীলকুঠিরটির অবস্থান। জন শ্রুতি আছে, বহুকাল আগে থেকে গ্রামটি বিভিন্ন পীর আউলিয়ার পদস্পর্শে ধন্যবলে এর  নাম হয় আউলিয়া পুর ।  এই গ্রামেই রয়েচে খ্যাতিমান আউলিয়া হযরত শাহসুফি খাজা ইউসুফ শাহ আহসানের দরগা শরীফ । অযত্নে অবহেলায় দরগাটি আজ জরাজীর্ণ।  দরগাটির অবস্থান নীল কুঠিরের পাশেই । ৫০ বছর আগে ও এই এলাকাটি ছিল ঘন জঙ্গলে আবৃত। এখানে বাস করত বাঘ সহ নানা ধরনের হিংস্র প্রাণী । এখন অবশ্য এখানেআর জঙ্গল নেই । প্রায় দুশ বছর আগের কথা । ডানলপ সাাহেব নামের একজন ইংরেজ নীল কর নীলের ব্যবসা কওে রাতারাতি কোটিপতি  হওয়ার বাসনা নিয়ে তিনি এসে ছিলেন  এই এলাকায় ।১২ একর জমির ওপর  তিনি স্থাপন করেন নীল কুঠি । এই নীল কুঠি আজ প্রায়  নিশ্চিহৃ ।  কুঠির জমিও বিভিন্ন ভাবে বেহাত হয়ে গেছে । কুঠির ধ্বংসাবশেষ এবং ইটের তৈরি ভবনের ভিওি পড়ে রয়েছে । আর স্মৃতি হিসাবে প্রায় অক্ষত রয়ে গেছে শুধু চুল্লিটি স্থানীয় ভাবে জানা গেছে, বৃহওর ফরিদপুরের অংশ হিসেবে মাদারীপুওে নীল চাষ শুরু হয় পলাশীর যুদ্ধের কিছুকাল পর থেকেই। এলাকার তৎকালীন কৃষকদের ধান,পাট, গম, সরিষা সহ অন্যাণ্য  ফসল  বাদ দিয়ে শুধূ মাত্র নীল  চাষে বাধ্য করা হত । যে জমিতে একবার নীল চাষ করা হতো সেখানে অন্য কোন ফসল চাষ করা সম্ভব হতো না। অত্যন্ত দরিদ্র কৃষকদেও বিপদেও সময় স্থানীয় দালালের মাধ্যমে সুদে ও দাদনের টাকা দিয়ে নীল চাষে প্রভাবিত করা হত। মাদারীপুরের ছিল নীল চাষ এর জন্য খুবই উপযোগী। তখন ইংরেজই এদিকে ভিড় জমিয়ে ছিল  নীল চাষ করতে। এই ডানলপ সাহেবের নীলকুঠির সাথে জড়িয়ে আছে। ঐতিহাসিক ফরায়েজী আন্দোলন। উপমহাদেশের ব্রিটিশদেও অত্যাচার যখন  চরম পর্যায়ে তখন নীলকুঠিয়াল ও তাদের দোসর জমিদার মহাজনদের  অত্যাচাওে এঅঞ্চলের কৃষকরাও জর্জরিত হয়ে পড়ে। এ সময়  মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের হাজী শরীয়তউল্লাহ ও তার পুত্রপীর মহসীনউদ্দিন দুদু মিয়া এলাকার কৃষকদের নিয়ে গড়ে তোলেন বিশাল এক লাঠিয়াল বাহিনী । এই প্রতিবাদ এক সময় গন আন্দোলনে রূপ নেয়। শরীয়তউল্লাহ মারা যাওয়ার পর তার ছেলে দুদুমিয়ার নেতৃত্বে ১৭৩৮সালে ব্রৃটিশদের সাথে নীলকুঠি থেকে  তিন কিঃমিঃ দুওে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত নীলকুঠিয়াল ডানলপ তার দলবল নিয়ে নীলকুঠি ছেড়ে পালিয়ে যায়। আউলিয়াপুরের যে স্থানে এই যুদ্ধ হ সেই স্থান এখনও রনখোলা নামে পরিচিত । বিলুপ্তপ্রায় ডানলপ নীলকুঠির পূর্ব পাশে রনখোলা,পশ্চিমে আউলিয়াপুর বাজার, উওরে কালীতলা ওদক্ষিনে আউলিয়াপুর দরগা শরীফ। ১২কক্ষ বিশিষ্ট  এ কুটির মাঝামাঝি অংশে রয়েছে চুল্লি, পাশেই রয়েছে প্রায় ৪০ ফুট উচু চিমনি। 




( দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু।)

ভ্রমণ :: মাদারীপুর।

মাদারীপুরের পর্বত বাগান 



প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা আমাদেও এ দেশ । এদেশের কোথাও কোথাও অবহেলিত ,অযত্নভাবে পড়ে আছে এসৌন্দর্য । সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ একটু সৌন্দর্যেও জন্য ছুটে যাচ্ছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত । যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্যের লীলাভূমি যেখানে মানূষ ছুটে গেছে  সৌন্দর্য পিপাসু  মানুষ সৌন্দর্য যেমন চয়ন করেছে তেমনি লালন করেছে প্রানের আবেগ দিয়ে । এমনি এক প্রকৃতিকপ্রেমি,সৌন্দর্যপিপাসু রাস বিহারী পর্বত মাদারীপুরের মস্তফাপুর ইউনিয়নের বড়বাড্ডা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন । ময়মনসিংহ জমিদার সেরেস্তার নায়েবের চাকরি শেষে আপন শখেই গড়ে তুলেছিলেন বাগান ।

তৈরি হয়েছিল যেভাবে 
১৯৩০সালে রাসবিহারী পর্বতদেশ-বিদেশি প্রায় ৫০০ জাতের ফল ও ফুলেরচারা সংগ্রহ কওে প্রায় ২০একর জমির ওপর গড়ে তোলেন এ বাগান । সেই থেকে তার নামানুসারে এ বাগান টি পর্বত বাগান নামে পরিচিত পায় । বাগানের পাশ দিয়ে বযে যাওয়া খরস্রোত কুমারনদ বাগানের আকর্ষনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে বাড়তি সৌন্দর্য এনে দেয় । নানা আকৃতির সুন্দও শৈল্পিক পথ বাগান প্রতিষ্ঠালগ্নে হাজার হাজার নারিকেল ও সুপারি গাছ বাগানটি ঘিরে রেখেছে । ছিল আম ,জাম ,কাঁঠাল,কামরাংগা, আমড়া,কুল,সফেদা , জলপাই, আমলকী, কমলা জামরুল,তেজপাতা,দারুচিনি, লবঙ্গ,এলাচ সহ দেশ বিদেমি বিভিন্ন ফল ও ভেষজ গাছ । বাগাটি নয়নাবিরাম করার জন্য গোলাপ,গন্ধরাজ টগর, কামিনী, হাসনাহেনা বকুল, জুই বেলি ,জবা সহ দেশ বিদেশী সংখ্য ফুলের গাছ । 

পবর্ত বাগানের সৌন্দর্য ও রূপ 
প্রয়ি ১২ রকমের গোলাপ গাছ ছিল পবর্ত বাগানে । বিচিত্র পাখির কল-কাকলিতে বাগানটি ছিল মুখরিত । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট বহু দেশি-বিদেশি পর্যটকও পিকনিক পার্টিও আগমন ঘটতো এ বাগানের শোভা দর্শনের প্রত্যাশায় । শীতকালে বাগান সংলগ্ন পুকুরের আগমন ঘটতো বিচিত্র পাখির ।ফলে খুব সহজেই আকৃষ্ট হতো পর্যটক । বাগানের মধ্যে ৬টি শান বাধানো পুকুরও রাজবিহারি পবর্তেও বাসভবনটি সবচেয়ে আকর্ষনিয় । এগুলো এখন পরিনত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে । ঠুয় এক সময় বৃহতর ফরিদপুর অঞ্চলের মধ্যে আর কোথাও চিত্য-বিনোদনের এবং পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো এমন নয়নাভিরাম পরিবেশ দ্বিতীয়টি ছিলনা। জানা যায় তৎকালীন মাদারীপুর মহকুমা শহরে যেসব উচ্চপদস্থ কর্মকতার আগমন ঘটেছিল তাদের প্রত্যেকেই এসেছিলেন এ বাগানে । গাছপালা ও নানা প্রজাতীর পাখির পাশা-পাশি এ বাগানে ছিল বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু । হসুমান , বানরের ছিল অবাধ বিচরন । নিবিঘ্নে তারা ঘুরে বেড়াতো বাগানের এ ডাল থেকে ওডালে । 

যেভাবে সৌন্দর্য হারালো 
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধেও সময় স্থানীয় কিছু রাজকার ও পাকসেনাদের দ্বারা নিমর্মভাবে রাজবিহারি পবর্ত নিহত হন । রাজকার ফকু মাতুব্বর দ্বারা দখল হয়ে যায় তার বাগান বাড়ি । এ মর্মান্তিক ঘটনার পর থেকেই বাগানটি তার ঐতিহ্য হারাতে বসে । এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা উজার করে দেয় বাগানের গাছপালা । বাগানের মধ্যে এখনো রাসবিহারি পবর্তের ১৪কক্ষ বিশিষ্ট দোতালা বাস ভবন, একটি মন্দির এবং বাবা রাজকুমার পবর্ত ও মা  বিধুমুখি পবর্তের দুইটি সমাধি সৌধ ঐতিহ্যের ধরক হয়ে আছে । 

কেমন আছে পবর্ত বাগানের উওরসূরী 
রাসবিহারি পবর্তের স্ত্রী শোভরানী পবর্ত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে দির্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন । ২ ছেলের মধ্যে বড়ছেলে রাজেন্দ্র বিহারি পবর্ত এখন বাগানের দেখাশোনা করেন এবং ছোট ছেলে রনজিৎ বিহারি পবর্ত স্কুলে শিক্ষকতা করেন । সরেজমিন গিয়ে আলাপ হয় রাসবিহারি পবর্তের বড়ছেলের স্ত্রী মালতী রানী পবর্তে সঙ্গে । তিনি বাড়ির গাছ-পালা ও পুকুর লিজদিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে কোন রকম সংসার চলে নানা ধরনের অত্যাচারের কথা বলে জানালেন , এখনো অনেকেরই সম্পওির উপর লোভ আছে । আমরা খুব ভয়ে থাকি  । 

বর্তমান অবস্থা  
বাগান ঘুরে দেখা যায় বেম কয়েকটি বসত বাড়ি । এদেও কেউ কেউ ্ক্রয় সূত্রে আবার কেউ দখল সূত্রে বাড়ি তৈরি করেছেন । আগের মতো বাগানটির শোভা  না থাকালেও কাছাকাছি জমিদার সুরেশ চন্দ্র পোদ্দারের বাড়ি মিলিয়ে  এলাকাটি আর্কষনীয়  ।  এব্যাপারে অধ্যাপক ডঃ অরুণ কুমার গোস্বামী বলেন  এ বাগানে অনেক দুর্লভ প্রজাতির গাছ আছে , যারক্ষা করা প্রয়োজন  । সরকার  ইচ্ছে করলেই  দক্ষিন বাংলার  ঐতিহ্য এ বাগান টি হতে পারে বিনোদ কেন্দ্র । মৌসুমে বেশ কয়েকটি পিকনিক পার্টি দেখা গেলেও পর্যটকদের  তেমন দেখা বেশী একটা দেখাযায় না । বাগানটি রক্ষা হলে  আবার হয়তো পরিবেশ প্রেমী সৌন্দর্যপিপাসু পযৃটকদেও পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে ঐতিহ্যবাহী পর্বত বাগান ।



সময় করে ঘুরে আসুন, নিজের দেশকে জানুন ও অপরকে জানান। 

ভ্রমণ :: টাঙ্গাইল ।

ঐতিহাসিক আতিয়া জামে মসজিদ



যমুনা, ধলেশ্বরী ও বংশী নদীবিধৌত টাঙ্গাইল জেলা। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক নিদর্শনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন বাংলার অনেক কৃতী পুরুষ যারা বিভিন্ন সময় এদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। এ মাটিতে শায়িত আছেন হযরত শাহান শাহ বাবা আহমদ কাশমিরী (রা.)। এই জেলার সন্তান মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। টাঙ্গাইলের শাড়ি এক সময় বিখ্যাত ছিল দেশ-বিদেশে, যা আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। এই টাঙ্গাইল শহরের একটি গ্রামেই কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মুঘল আমলের তৈরি আতিয়া জামে মসজিদ।

আতিয়া মসজিদ : টাঙ্গাইল শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দূরত্বে লৌহজং নামক নদীর তীরবর্তী পূর্ব পাশে নির্মাণ করা হয় আতিয়া জামে মসজিদে। মসজিদের পাশে পশ্চিমে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা পুকুর। পূর্ব- পশ্চিমে এই মসজিদের আয়তন দৈর্ঘ্য ৬৯ ফুট এবং প্রস্থ ৪০ ফুট। মিনারগুলো অলঙ্কৃত হয়ে গম্বুজের আকৃতি নিয়ে সমাপ্ত হয়েছে। আতিয়া মসজিদে দুটি ভাগে বিভক্ত, একটি অভ্যন্তরীণ এবং অপরটি বারান্দা। প্রধান কক্ষ অথবা নামাজ পাটের কক্ষের প্রত্যেক বাহু প্রায় ২৫ ফুট লম্বা, মূল কক্ষের ওপরে বৃহদাকারের গ¤ভুজ রয়েছে। পূর্ব দিকে বারান্দা, যেখানে তিনটি গ¤ভুজ রয়েছে। পূর্ব দেয়ালে তিনটি প্রবেশ পথ। প্রবেশ পথের উপরাংশ প্রায় গোল গ¤ভুজসদৃশ। দরজায় কাঠের পান্না অনেক ভেতরে। মসজিদের প্রবেশ পথের কাছে একটি শিলালিপি রয়েছে। যেখানে শিলালিপি স্থাপিত তার চারপাশের এলাকা অলঙ্করণযুক্ত। মসজিদটি দীর্ঘদিনের পুরনো বলে অলঙ্করণে আদিরূপ ক্ষয়িষ্ণু অথবা অনুপস্থিত থাকায় মূলত কি ধরনের অলঙ্করণ ছিল তা শনান্ত করা কঠিন। মসজিদের শিলালিপির পাঠ মতে, ১০১৮ হিজরি তথা ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে বায়েজিদ খান পন্নীর পুত্র সাঈদ খান পন্নী পীর আলী শাহান শাহ বাবা কাশ্মীরির সম্মানে এটি নির্মাণ করেন ১৬০৯ খ্রি. এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। পীর শাহান শাহ এতদঞ্চলে বাবা কাশ্মীরি বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অতিশয় ঘনিষ্ঠ এবং সম্মানীয় ব্যক্তি। মুসলিম ধর্মে একজন দরবেশ। তিনি যখন ধর্ম প্রচারের জন্য এই এলাকায় আসেন তখন সম্রাট তাকে দুটো এলাকার বন্দোবস্ত করেছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে আটিয়া পরগনা অপরটি কাগমারী পরগনা।



যেভাবে যেতে হবে : সিলেট থেকে সরাসরি টাঙ্গাইল অথবা ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার আগে পাকুল্লা নামক স্টেশন থেকে টেম্পোতে করে পাথরাল বাজার পর্যন্ত। সেখান থেকে ভ্যান অথবা রিকশায় একেবারে মসজিদে পর্যন্ত পৌঁছা যায়। 

ভ্রমণ :: নারায়ঙ্গঞ্জ ।

নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ দুর্গ 


নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক হাজীগঞ্জ কেল্লার স্থানটির সামনে দাঁড়াতেই বুকটা কেমন যেন ধক করে উঠল। অদ্ভুত সুন্দর বিশাল এক কেল্লা। একটু একটু শিহরণও জাগল ভেতরে এই ভেবে, এ বিশাল কেল্লাটি তৈরি করা হয়েছিল যুদ্ধের জন্য। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে মোগল শাসক ঈশা খাঁ মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের কবল থেকে এ জনপদকে রক্ষা করার জন্য শীতলক্ষ্যা-ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা নদীর মিলন স্থলে কেল্লাটি নির্মাণ করেন। এখানে দিনের পর দিন না জানি কত যুদ্ধ হয়েছে। সুগঠিত এ কেল্লার নাম খিজিরপুর দুর্গ যা বর্তমান হাজীগঞ্জের দুর্গ বা কেল্লা নামে পরিচিত। ১৭০০ শতাব্দী বা তারও আগে নির্মিত এ দুর্গের সঠিক স্থপতির নাম তেমন পরিষ্কারভাবে কোথাও নেই। তবে ধারণা করা হয়, সম্ভবত সুবেদার ইসলাম খানের সঙ্গে সংঘর্ষকালীন ঈশা খাঁ এ দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর রাজধানী সোনারগাঁয়ের নিরাপত্তার জন্য মীর জুমলা অধিকাংশ সময় অবস্থান করতেন এ কেল্লায়। প্রায় দুই কিলোমিটার জায়গা নিয়ে বিস্তৃত এ খিজিরপুর (হাজীগঞ্জ) দুর্গ। চারপাশ আবদ্ধ এ কেল্লাটির দৈর্ঘ্য পূর্ব-পশ্চিমে ২৫০ ফুট এবং উত্তর-দক্ষিণে ২০০ ফুট। একটি সু-উচ্চ প্রধান ফটক রয়েছে দুর্গের পূর্বদিকে। রয়েছে কয়েকটি গোপন দরজা কেল্লার বিভিন্ন দিকে। দুর্গজুড়ে রয়েছে আÍরক্ষার জন্য মাটির উঁচু বাঁধ, যার মাঝে রয়েছে ছোট ছোট ফাঁকা জায়গা সেখানে অস্ত্র রেখে মোকাবিলা করা হতো শত্র“দের। দুর্গের মাঝে পুরোটাই ফাঁকা মাঠ। ধারণা করা হয়, এখানে অবস্থান নেয়া-সৈন্যরা এ মাঠে তাঁবু খাটিয়ে থাকত। সেই সময়ে যেহেতু নদীপথই ছিল যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম তাই নদীপথের আক্রমণ রুখতে নদীর তীরবর্তী জায়গাতেই নির্মাণ করা হয় এ দুর্গটি। এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মীর জুমলা খানও অধিকাংশ সময় এ দুর্গে কাটাতেন। বিশেষ করে বর্ষার সময় তিনি এ খিজিরপুর (হাজীগঞ্জ) দুর্গের ভার নিজ হাতে গ্রহণ করতেন। প্রতিহত করতেন নৌপথে অভিযানকারী জলদস্যুদের। সময়ের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন লোক ব্যবহার করতেন এ দুর্গ নিরাপত্তার জন্য। আবার কখনও এখান থেকে পরিচালনা করেছেন যুদ্ধ। এক সময় ঢাকার নবাবেরা এটিকে ঘিরে হাফেজ মঞ্জিল নামক একটি প্রাসাদ ও উদ্যান নির্মাণ করে ছিলেন এমন জনশ্র“তিও আছে। সময়ের ব্যবধানে এক সময়ের রক্ত হিম করা নাম খিজিরপুর (হাজীগঞ্জ) দুর্গ এখন এক নীরব নিস্তব্ধ পুরাকীর্তি। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ক্রমেই ক্ষয়ে পড়া এ দুর্গের অভ্যন্তর এখন ব্যবহƒত হয় গৃহপালিত পশুর চারণভূমি অথবা শিশু-কিশোরদের খেলার নির্ভরযোগ্য স্থান হিসেবে। কেল্লার পথে খাসজমির ওপর পাট গুদামগুলো স্বাধীনতার পর থেকে অস্থায়ী লিজের কারণে সৌন্দর্য ক্ষুণœœ হতে থাকে। যদিও মাঝে মাঝে চলে প্রশাসনের লোক দেখানো সংস্কার যা উল্লেখ করার মতো কিছুই নয়। আর এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্প বলে প্রতীয়মান হবে। 

ভ্রমণ :: কুমিল্লা।

কুমিল্লার জাহাপুর জমিদার বাড়ি


হাতিশালায় হাতি নেই, আস্তাবলে ঘোড়া নেই, সিংহ দরজায় সিংহ নেই দালানগুলোই শুধু স্মৃতি বহন করছে ৪০০ বছর আগের এ জমিদার বাড়িটির। কুমিল্লার মুরাদনগরের জাহাপুরে এর অবস্থান। গোমতি বিধৌত এ জাহাপুর। গোমতির কল কল ঢেউয়ের তালে তালে এক সময় বয়ে চলত জমিদারদের ‘গয়না’ নৌকা। তাদের ব্যাপারে বাংলার বার ভূঁইয়ার এক ভূইয়া কেঁদার রায় নাকি বলেছিলেন, মেঘনার পূর্ব পাড়ে কোন বড় জমিদার নেই। শাকের মধ্যে লবণতুল্য আছে জাহাপুরের জমিদাররা।

কি কি দেখবেন

জমিদার বাড়িতে পৌঁছেই দেখবেন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে দুটি সিংহ। তারা আপনাকে এ বাড়িতে নিঃশব্দে স্বাগত জানাবে। প্রধান ফটকে সবসময় দু’জন রক্ষী থাকত। জমিদারি আমলে এলে পরিচয় দিয়ে ঢুকতে হতো। এখন আর সেদিন নেই। রাইফেল অথবা তীর-ধনুক হাতে মাথায় পাগড়ি নিয়ে কোন শিখকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবেন না। বহিরাঙ্গন এবং অন্দরমহল তারাই দেখতেন। আপনাকে মূল গেটে দেখে হয়তো কেউ এগিয়ে আসবেন। তিনি আপনাকে মূল বাড়িতে নিয়ে যাবেন।
প্রথম বিল্ডিংটি তিন তলা। পুরোটাই ইট-সুরকি দিয়ে নির্মিত। এরকম আরও ৯টি বিল্ডিং ছিল। ২টি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু জড়াজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বাকিগুলো ভালো। ১মটি বাদে বাকি সবগুলো দোতলা। প্রধান গেট দিয়ে প্রবেশ করেই একটি মন্দির দেখতে পাবেন। এটি নাট মন্দির। দুর্গা পূজার সময় এখানে ভক্তরা সমবেত হন। পাশেই রয়েছে দুর্গাদেবীর প্রতিমা। প্রতিমাটি স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা হয়েছে।
এখান থেকে সোজা চলে যাবেন অন্দর মহলে। এ মহলেই বর্তমান বংশধররা বসবাস করছে। এখানে দেখা হবে ১১তম বংশধর শ্রী আশীষ কুমার রায়, সমরেন্দ্র রায় ও অজিত কুমার রায়ের সঙ্গে। এছাড়া রয়েছেন প্রফেসর অঞ্জন কুমার রায়, অধ্যক্ষ রঞ্জন কুমার রায় ও তাদের পরিবারবর্গ। তারাই বর্তমানে এ বিশাল বাড়িটি দেখাশোনা করছেন। জমিদারদের আরও ২টি পরিবার এখানে বসবাস করছে। তবে ওই পরিবারগুলোর অধিকাংশ সদস্যই জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করছেন। তাই তাদের কারও সঙ্গে আপনার দেখা নাও হতে পারে। আপনার চোখের সামনের ভবনটির দরজার ওপরে খোদাই করা লেখা ‘১৩৩৪ বঙ্গাব্দ’ দেখবেন। এটি তৈরি করেছন অঞ্জন কুমার রায়ের দাদা অশ্বিনী কুমার রায়।
এটি জমিদার বাড়ির সর্বশেষ ভবন। এর সামনে প্রশস্ত বারান্দা রয়েছে। ফ্লোর থেকে ছাদের উচ্চতা ১৪ ফুট। ছাদের নিচের অংশে কাঠের এবং লোহার তৈরি কারুকার্যময় সিলিং দেখতে পাবেন। দোতলায় ওঠার জন্য সরু সিঁড়ি দেখতে পাবেন। একটু ওঠে মাঝখানে দাঁড়াবেন। দোতলায় ৮ থেকে ১০টি কক্ষ। ইচ্ছে করলে ছাদ থেকে প্রায় ৩ একর আয়তনবিশিষ্ট পুরো জমিদার বাড়িটি দেখতে পারেন।
১৮৬২ সালে এ বংশের লোকরা জমিদারি লাভ করেন। জমিদারি শুরু করেন গৌরি মোহন। তার ভাই রাম দয়াল ও কমলা কান্ত তাকে সহযোগিতা করেন। তাদের অওতাধীন বর্তমান তিতাস, মুরাদনগর, দাউদকান্দি, চান্দিনা, দেবিদ্বার ও নবীনগর বিস্তৃত ছিল। নাস্তা শেষে আবার বাড়িতে প্রবেশ করুন। বাড়ির বাইরের অংশের একটি ঘরে উঁচু রথ দেখতে পাবেন। লোকজনের মুখে জানবেন, জমিদার অশ্বিনী কুমার রায় ১৩২৪ বঙ্গাব্দে জগন্নাথ দেবের রথ ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। আপনি যদি রথ যাত্রার সময় যান তাহলে দেখবেন হাজার হাজার ভক্ত সমবেত হয়।
বাড়ির বাইরের অংশে সুউচ্চ দেয়াল দেখবেন। একদিকে কাঁটা তারের বেড়া রয়েছে। একে একে সবগুলো ভবন ঘুরে দেখুন। দেখবেন কোনটা আই টাইপ, কোনটা এল টাইপে নির্মিত। সবগুলো ভবনেই সুশোভিত নকশা রয়েছে। সবগুলোতে ফুলের নকশা করা হলেও একই ধরনের ফুল ব্যবহার করা হয়নি। এমনকি জানালার গ্রিলগুলোতেও নকশা করা রয়েছে। এ ধরনের নকশা আজকাল আর দেখা যায় না। জমিদার বাড়ির লোকদের কাছে জানবেন, বাড়িগুলোর নকশা তৈরিতে ঢাকার বিক্রমপুরের মিস্ত্রিরা কঠোর পরিশ্রম করেছেন। এগুলো মুঘল রীতিতে তৈরি।
এবার প্রবেশ করুন রানী মহলে। সেখানে গিয়ে রানী নন্দ রানী, মহামায়া রায়, ও শ্যামা সুন্দরী দেবীর স্মৃতি মনে পড়বে। রানী মহলের সামনে একটি পুকুর ছিল। ওই পুকুরের পানিতে জাফরান মিশিয়ে রানীরা গোসল করতেন। এছাড়া হস্তচালিত পাম্পের মাধ্যমে ৩ তলায় পানি উঠিয়ে রানীরা গৃহকর্ম সম্পাদন করতেন।
এবার চলে আসুন বেডরুমে। জমিদারদের ব্যবহƒত শৌখিন খাট, নকশা করা চেয়ার, গা এলিয়ে দেয়া ইজি চেয়ার, কারুকার্যখচিত ফুলদানি সবকিছুই দেখতে পাবেন। কাউকে জিজ্ঞেস করলে জানবেন, সেগুন কাঠের তৈরি নকশা করা আসবাবপত্রগুলো শতাধিক বছরের পুরনো। এবার আয়নামহলের দিকে এগিয়ে যান। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাচ-গানের আসর বসত। ওই সময় ব্যবহƒত দু-একটি হ্যাজাক লাইট দেখতে পাবেন। শৌখিন জমিদাররা জারবাতি ব্যবহার করতেন। তবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় সেগুলোতে মোমবাতি ব্যবহার করা হতো। তখন কোন বৈদ্যুতিক পাখা না থাকায় হাতে টানা পাখা ব্যবহার করা হতো। এমন পাখা রঞ্জন বাবুর কাছে সন্ধান করলে দেখতে পাবেন।
জমিদার গিরিশ চন্দ্র রায়ের পুত্র হেম চন্দ্র রায় সংস্কৃতিবান ছিলেন। তার আমলে জলসা ঘরে বড় ধরনের সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠান হতো।
বসতঘরের সামনে একটি ছোট্ট বাগান দেখতে পাবেন। এ বাগানে এক সময় শোভা পেত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আনা রঙ-বেরঙের ফুল গাছ। উড়িষ্যা থেকে আনা গোলাচি গাছটি দীর্ঘ দিন জীবিত ছিল। এখনও আছে নয়নাভিরাম পারিজাত, চাপা, ম্যাগনেশিয়াম ও কনকচাঁপা। এছাড়া পৃথক ফলবাগানও ছিল।
এবার আপনি চলুন ডাইনিং পে¬সে। এখানে নিয়মিত কয়েকজন পাকা রাঁধুনি থাকত। জমিদার পরিবারের সদস্য ছাড়াও খাওয়া-দাওয়া করত পাইক-পেয়াদা ও খাজনা আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারীরা। জমিদারদের ব্যবহƒত শ্বেত পাথরের একটি পে¬ট দেখে নিজের চোখকে ধন্য করতে পারেন। ভাত খাওয়ার পর ফল খাওয়া ছিল তাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। তখনকার যুগে হাটবাজার কিংবা গলির মোড়ে আপেল-আঙ্গুর পাওয়া যেত না। নিজস্ব গয়না নৌকা দিয়ে চাঁদপুর গিয়ে সেখান থেকে স্টিমারে কলকাতা গিয়ে আপেল, আঙ্গুর নিয়ে আসা হতো। ডাইনিং পে¬সের চারদিকে চোখ রাখুন, দুর্লভ অনেক কিছু চোখে পড়বে। বর্তমানে আমরা পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ফিল্টার ব্যবহার করি। আজ থেকে ১শ’ বছর আগেও জমিদাররা যে কতটা স্বাস্থ্যসচেতন ছিলেন তা দরজার পাশে রাখা ফিল্টারটির দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। ফিল্টারটির নিচের অংশে চোখ নিলে দেখতে পাবেন ছোট্ট করে লেখা রয়েছে, ‘মেইড ইন লন্ডন’।
এবার খাওয়ার ঘর থেকে বেড়িয়ে আসুন। বের হওয়ার রাস্তায় দেখবেন একটি ছাতা। তবে এটি যেনতেন ছাতা নয়, রুপার হাতলের ছাতা। জমিদার বাবুরা যখন প্রজাদের সুখ-দুঃখ দেখার জন্য বের হতেন তখন দু’জন লোক এটি বয়ে বেড়াত।
মূল বাড়ি থেকে বের হয়ে এবার শ্মশানে চলে আসুন। এখানে সমাহিত রয়েছেন জমিদার রাম মোহন রায়, কৃষ্ণমোহন রায়, গৌরি মোহন রায়সহ বহু জমিদার। তবে হিন্দুরীতি অনুযায়ী আগুনে দাহ না করে মাটি দেয়া হয় সাধু পুরুষ কমলাকান্ত রায়কে। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় মোমবাতি জালানো হয়। হিন্দু-মুসলমান সবাই তাকে সম্মান করত। তার ভক্তদের মুখে শুনবেন তার সমাধির সামনের পুকুরটির নাম ফেনপুকুর । এক সময় বহু ভক্ত এখানে আসত। তাদের জন্য ফ্রি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। শোনা যায়, তাদের জন্য রান্না করা ভাতের মার ফেলতে ফেলতে এ যায়গাটি গর্ত হয়ে পুকুরটির সৃষ্টি হয়েছে।
সমাধি সৌধ অতিক্রম করে সামনে গেলে দেখতে পাবেন বেশ কয়েকটি মন্দির। এলাকাবাসরী মুখে শুনবেন, শুধু মন্দির নয় জাহাপুরের জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট, মাদ্রাসা, হাইস্কুল, পোস্ট অফিস ও দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে উঠেছে। হাতে সময় থাকলে সব ঘুরে ঘুরে দেখবেন। এ সময় আপনাকে সহযোগিতা করবেন জমিদার বংশের বারতম বংশধর অধ্যক্ষ রঞ্জন কুমার রায়।

কিভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ ও রাজধানী সুপার মার্কেটের সামনে থেকে কুমিল্লা অথবা কোম্পানীগঞ্জগামী সৌদিয়া, তিশা অথবা অন্য কোন লাক্সারিয়াস বাসে উঠবেন। ময়নামতি সংলগ্ন ক্যান্টেনমেন্টে পৌঁছবেন কুমিল্লা শহরের আগে মাত্র ২ ঘণ্টায়। কোম্পানীগঞ্জের বাসে উঠলে আর বাস পরিবর্তন করতে হবে না। কুমিল্লার বাসে উঠলে ময়নামতিতে নামতে হবে। এখান থেকে আবার কোম্পানীগঞ্জের বাসে উঠে দেবিদ্বারের পান্নারপুলে নামতে হয়। সেখান থেকে বাখরাবাদ রোডে ১০ কিলোমিটার গেলেই জাহাপুর পৌঁছতে পারবেন।

ফেরার পথ
যদি নিজস্ব যানবাহনে আসেন তাহলে দিনে দিনেই ফিরতে পারবেন। সমস্যা হলে কোম্পানীগঞ্জ অথবা দেবিদ্বারের কোন হোটেলে উঠুন। অথবা ১ ঘণ্টা হাতে নিয়ে কুমিল্লা শহরের অন্য যে কোন হোটেলে উঠুন। বাসায় ফেরার সময় প্রিয়জনের জন্য ঐতিহ্যবাহী খদ্দরের পোশাক এবং রসমলাই নিয়ে যেতে ভুলবেন না কিন্তু! 

ভ্রমণ :: ঢাকা , হোসেনী দালান।

মোগল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র সুবাদার শাহ সুজার আমলের হোসেনী দালান 



হোসনী দালান পুরানো ঢাকায় অবস্থিত শিয়া সম্প্রদায়ের একটি ইমারত। বাংলায় নির্মিত মোগল শাসনামলের দর্শনীয় স্থাপনার মধ্যে ঢাকার হোসেনী দালান একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য নিয়ে আজও টিকে রয়েছে। দালানটি মূলত একটি স্মৃতিসৌধ। হজরত ইমাম হোসেন (রা.) এর স্মৃতির উদ্দেশ্যে এটি নির্মিত হওয়ার কারণে এর নামকরণও হয়েছে তারই নামানুসারে অর্থাৎ হোসেনী দালান। হোসেনী দালানটি নির্মিত হয় মোগল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র বাংলার সুবাদার শাহ সুজার আমলে। শাহ সুজা ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী শাসক। তিনি যখন সুবাদার হয়ে বাংলায় আগমন করেন, তখন তার সঙ্গে করে তিন শতাধিক শিয়া অনুচর ও তাদের পরিবার এদেশে নিয়ে আসেন। শাহ সুজার নৌবাহিনী প্রধান-শিয়া মতাবলম্বী অনুচর সৈয়দ মীর মুরাদ এই হোসেনী দালান তৈরি করেন।
কথিত রয়েছে, সৈয়দ মীর মুরাদ এক রাতে স্বপ্নে দেখতে পান, কারবালার যুদ্ধের স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করছেন এবং স্বপ্নে মীর মুরাদকেও অনুরূপ একটি দালান নির্মাণের নির্দেশ দিচ্ছেন। স্বপ্নে নির্দেশ লাভ করে মীর মুরাদ ১৬৪২ খিস্ট্রাব্দ নাগাদ হোসেনী দালানটি নির্মাণ করেন। বাংলায় মোগল নির্মিত অন্য সব স্থাপনার মতো এটিও মোগল স্থাপত্য রীতি-নীতি অনুসারে নির্মিত হয়। ঢাকার নায়েব নাজিমগণ শিয়া মতাবলম্বী হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন তারাই হোসেনী দালানটির মুতাওয়াল্লী ছিলেন।
দালানের দুই দিকে রয়েছে দুইটি মিনার, দক্ষিণ দিক ঘেঁষে বিশাল পুকুর আর উত্তর দিকে প্রশস্ত মাঠের পর বিশাল গেটওয়ে। ভবনটি দ্বিতল আকৃতি বিশিষ্ট। নিচে রয়েছে কবরখানা। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে জরিখানা, হুক্কাখানা, নিশিত খাঁ নামের তিনটি কক্ষ। হোসেনী দালানটি নির্মাণের পর এখান থেকে বিভিন্ন উৎসবে জাঁকজমকপূর্ণ ও সজ্জিত মিছিল বের হতো। এছাড়া রয়েছে নহবতখানা, যেখানে প্রতিটি চাঁদ দেখার রাত থেকেই শুরু হতো নহবত বাজানো। 

ভ্রমণ :: বরিশাল, দুর্গ‍া সাগর দীঘি।

ইতিহাসখ্যাত দুর্গা সাগর দীঘি




ঐতিহাসিক নিদের্শনসমৃদ্ধ দেশের দক্ষিনাঞ্চলের জেলা বরিশাল। বর্তমানে বিভাগীয় শহর । অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল ও সবুজ বেষ্টনী ঘেরা এ জেলায় জম্নগ্রহন করেছেন প্রথিতযশা, রাজনীতিক,শিল্পী, সাহিত্যিকসহ অনেক গুনীজন। ইতিহাসখ্যাত এই বরিশাল জেলার একটি ইউনিয়ন মধাব পাশা। চন্দ্রদ্বীপ রাজারা এখানে প্রায় ২০০ বছর রাজ্য শাসন  করে ছিলেন। মাধবপাশা বিভিন্ন গ্রামে সেসব রাজ-রাজাদের বাস ভবনের ভগ্নাবশেষ আজও মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে । মাদবপাশার নয়নাভিরাম দুর্গাসাগর দীঘি সেই রাজাদেরইএক কীর্তি  । জনশ্রুতি এবং তথ্যনুসন্ধানে জানাযায়, ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে এই দীঘিটি খনন করার তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যেও পঞ্চদশ  রাজা শিব নারায়ন রায় । বাংলায় বারো ভূইয়ার একজন ছিলেন তিনি । স্ত্রী দুর্গাবতীর প্রতি ভালোবাসার গভীরতা প্রমানের জন্যই নাকি তিনি রাজকোষ  থেকে ৩লাখ টাকা ব্যয়ে দীঘিটি খনন করান। কথিত আছে, রানী দুর্গাবতী একবাওে যতোদুর হাটতে পেরেছিলেন ততোখানি জায়গা নিয়ে  এ দীঘি খনন করা হয়েছে। জনশ্র“তি অনুযায়ী, এক রাতে রানী প্রায় ৬১ কানি জমি হেঁটেছিলেন । রানী দূর্গাবতীর নামেই দীঘিটির নাম করন করা হয় দুর্গাসাগর দীঘি। সরকারী হিসাব অনুযায়ী দীঘিটি ৪৫ একর ৪২ শতাংশ জমিতে অবস্থিত। এর ২৭  একর ৩৮ শতাংশ জলাশয়  এবং ১৮ একর ৪শতাংশ পাড় । পাড়টি উওর- দক্ষিনে লম্বা ১৪৯০ফুট এবংপ্রশস্ত পূর্ব পশ্চিমে ১৩৬০ ফুট। কালের বিবর্তন ধারায় দীর্ঘিটি তার ঔজ্জ্বল্য কিছুটা হারিয়েছে, এ কথা সত্যি  তবে  প্রতি শীত মৌসুমের শুরুতে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে এখানে নানান প্রজাতির পাখি আসে  । সরাইল ও বালিহাঁস সহ নানান  প্রজাতির পাখি দীঘির মাঝখানে ঢিবিতে আশ্রয় নেয় । সাঁতার কাটে দীঘির স্বচ্ছ, স্ফটিক পানিতে । কখনো বা হালকা শীতের গড়ানো দুপুওে ঝাকঁ বেঁধে ডানা মেলে দেয় আকাশে । কালে কালে দীঘিটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় ইংরেজ শাসনামলে  তৎকালীন জেলা বোর্ড ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে এটির সংস্কার করে । স্বাধীনতা উওরকালে ১৯৭৪ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের মন্ত্রী আবদুর বর সেরনিয়াবাত দীঘিটি সংস্কারের উদ্যোগ নেন ।  এ সময়  তিনি তৎকালীন বরিশাল জেলা প্রসাশক নুরু আহাদ খানের সহয়োগিতায় দূর্গা সাগর উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেন । পরিকল্পনা অনুযায়ী দীঘির মাঝামাজি স্থানে অবকাশ যাপন কেন্দ্র নির্মানের জন্য  মাটির ঢিবি তৈরি করা হয়  । দীঘির চারপাশে নারিকেল ,সুপারি, শিশু, মেহগনি প্রভৃতি বৃক্ষরোপন কওে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হয় । যা বর্তমানে দীঘিটির মোভা বর্ধন করে চলছে। দিঘির চার পাশে চারটি সুদৃশ্য বাধানো ঘাট থাকলেও  পূর্ব দক্ষিন  পাশের ঘাট দুটির অস্তিত্ব  বিলীনহয়ে গেছে । পশ্চিম পাড়ে ঘাট সংলগ্ন  স্থানে রয়েছে জেলা পরিষদেও ডাক বাংলো । ইচ্ছা করলে ভ্রমনকারীরা এখানেরাত কাটাতে পারেন  ।

কিভাবে যাবেন -বরিশাল জেলা শহর থেকে মাত্র ১২ কিঃমিঃ দূরে এই মধাব পাশা ইউনিয়ন  । বরিশালথেকে  চাখার যাওয়ার  পথেই পড়বে দূর্গা সাগর দীঘি । ঘুরে আসুন প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীণ কীর্তি । 


ভ্রমণ :: মাদারীপুর।

টেকেরহাট সেতু



ঢাকা থেকে বের হলেই সড়কপথে মাত্র চার ঘন্টায় পৌঁছা যায় টেকেরহাট। মাদারীপুর জেলার একটি বন্দর টেকেরহাট। খাল-বিল-ঝিল-নদী-নালা জলের মতো ছড়িয়ে রয়েছে এখানে। সবুজ-শ্যামল স্নিগ্ধতা নদীমাতৃক টেকেরহাটকে করেছে যেন আরও বৈচিত্র্যময় ও রূপসী ।এখানে বিলের কাছে এলেই শোনা যায় বিরহী ঘুঘুর একটানা ডাক । এখানকার বিলে-ঝিলে ফুটে আছে শাপলা-সাদা, লাল কিংবা গোলাপি । দেখবেন এরই পাশে এক ঝাঁক রাজহাঁস আপন মনে খেলছে। এ দৃশ্য দেখতে কার না ভালো লাগে । রূপসী বাংলাকে আপন করে পেতে চাইলে একটিবারের জন্য হলেও টেকেরহাটে আসুন ।

যেভাবে যাবেনঃ- ঢাকা থেকে টেকেরহাট যাওয়ার বাস ছাড়ে গাবতলী এবং সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে । সার্বিক,চন্দ্রা ,হানিফের যে কোনো একটি পরিবহনে উঠুন। সমায় লগবে চার ঘন্টা। ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ টাকা। 
যেভাবে থাকবেনঃ- রাত যাপন করার জন্য ডাকবংলো সওজের মিল্কভিটার গেস্ট হাউস রয়েছে ।এ ছাড়া অন্যান্য উলে¬খযোগ্য হোটেলের মধ্যে হোটেল সবুজ,হোটেল তানিয়া রয়েছে । এর যে কোনো একটিতে উঠতে পারেন । 

যা যা দেখবেন -এখানে কুমার নদীর তীরে মিল্কভিটার বিশাল এক কম্পাউন্ডে ঘুরে বেড়াতে পারেন অনুমতি নিয়ে  পাশেই কুমার নদীর ওপরে ব্রিজ ।এই ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে পূর্ব-পশ্চিম যে দিকেই তাকান না কেন, দেকবেন কুমার নদী এঁকে-বেঁকে বয়ে গেছে । পানসি নৌকা নিয়ে মাঝি চলে যাচেছ । তখন তো মনে পড়বেই শচীব দেব বর্মনের গাওয়া  ঝিলমিল ঝিলের জলে ঢেউ খেলিয়া যায় রে ...গানের কথাগুলো । কুমার নদীতে নৌবিহার করার জন্য নৌকা পাবেন । নৌকা নিয়ে দূরে বহু দূরে বিল-ঝিলের দিকে চলে যাণ ।সামনে যা কিছু দেখবেন সবই যেন সবুজের আদিগন্ত সাগর । এসব দেখতে দেখতে মনে পড়ে কবির লেখা ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী । ফুলে ওফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবনী গানের এ কথাগুলো !নয়নভোলা দৃশ্য দেখতে দেখতে বিলের কাছ থেকে হেঁটে আসুন।তখন বারবার  চোখে পড়বেই কত না প্রজাতির পাখি ।বিলে মাছ ধরার দৃশ্য দেখেও মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকবেন।এখানকার নদী-খাল-বিল,পলাবন ভূমি, পুকুর-দিঘিতে এতই মাছ জম্মায় যে, তা এ এলাকার চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃও থাকে। এখানকার মৎস্য চাষিরা শুধু প্রাকৃতির মাছের ওপরই নির্র্ভর করেই বসে নেই।পুকুর-দিঘিতে চাষ করছে দেশি মাছ। যেমন-চিতল,আইড়, বোয়াল,টাকি শোল ,কই,মাগুর,চিংড়ি আরও কত কি!এসব পুকুর-ঘের ঘুরে দেখায়ও বেশ আনন্দ রয়েছে। এসব দেখে দেখে আপনিও হয়তো মাছ চাষে উৎসাহী হয়ে উঠবেন ।এখানে প্রাচীন আমাদের মন্দির, জমিদার বাড়ি ,মঠ,ঐতিহাসিক রাজা রামমন্দির, অন্নপূর্নার মন্দির ,বালেশ্বরের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জমিদার অগ্নিপুরুষ চিও প্রিয় রায় চৌধুরীর বাড়ি ও সমাধিসৌধ, কবি কিরন চাঁদ দরবেশের বাড়িসহ অনেক জমিদার বাড়ি ওছড়িয়ে রয়েছে । ঘুরে ঘুরে এসব ওদেখে নিন ।গ্রাঁয়ের পথে ভ্যান নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় কার ও সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে ও যেতে পারে । হয় তো নতুন বন্ধুটি বলবে-তুমি যাবে ভাই,যাবে মোর সাথে/আমার ছোট গাঁয়/গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের রায় ...।’গিয়ে দেখুন না,বন্ধু কতই না আতিথেয়তা দেখাবে । মনে রখবেন বন্ধুর মত বন্ধু পেলে টেকেরহাট গেলে এমনটি হয় ।জ্যোৎস্না রাতে টেকেরহাট ব্রিজের ওপর বসে থাকতে আরও বেশি আনন্দ...। তাই বারবার টেকেরহাটের কুমার নদীর তীরে ছুটে যেতে মন চাইবে।

কত টাকা খরচ হবেঃ- ২থেকে ৩দিন টেকেরহাটে থাকবেন ।এ ভ্রমনে প্রায় দেড় হাজার টাকা খরচ লাগবে । 



ভ্রমণ ;; হবিগঞ্জ।

রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য



রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। ঢাকা থেকে ১৩০ কিলোমিটার পূর্বে উত্তর দিকে এবং সিলেট থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে পশ্চিম দিকে অবস্থিত। অভয়ারণ্যটি রেমা ছনবাড়ী এবং কালেঙ্গা বিটের সমন্বয়ে গঠিত। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে রেমা চা-বাগান, পূর্ব-দক্ষিণ দিকে ভারতীয় ত্রিপুরা রাজ্য এবং পূর্বদিকে ভারত হিল রিজার্ভ ফরেস্টের অংশ। ১৯৮১ সালে ওই রিজার্ভ ফরেস্টের ১০৯৫ হেক্টর এলাকাকে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৬ সালে ফরেস্টের আরও কিছু অংশ বৃদ্ধি করে মোট ১৭৯৫ হেক্টর এলাকাকে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ্য, রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক একমাত্র ভার্জিন বন। মূল বনে পৌঁছার যোগাযোগ মাধ্যম হল চুনারুঘাট উপজেলা থেকে সিএনজি অথবা জিপ। 




জৈববৈচিত্র্য : উদ্ভিদ : এই অভয়ারণ্যে ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ গাছপালা-লতাপাতা আছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদগুলো হচ্ছে আওয়াল, সেগুন, কাঁকড়া, নেউর, হারগাজা, গন্ধরই, হরীতকী, বহেরা, জাম, ডুমুর, কাঁঠাল, চামকাঁঠাল, কাউ, কদম, রাতা, চিকরাশী, চাপালিশ, নিম, বনমালা ইত্যাদি।
প্রাণীকুল : এ অভয়ারণ্যে ৭ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬৭ প্রজাতির পাখি যেমন ভিমরাজ, পাহাড়ি ময়না, কাও ধনেশ, বনমোরগ বা মুরগি, ফোটা কান্টি সাতভারলা, শ্যামা, শালিক, শামুক খাওরি, টুনটুনি ইত্যাদি এবং ৩৭টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাণী হচ্ছে বন্যশূকর কাল, বন্যশূকর সাদা, বানর, হনুমান, মুখপোড়া হনুমান, খরগোশ, ছোট হরিণ, মেছোবাঘ, মেছোবিড়াল, বনকুকুর বা রামকুত্তা ইত্যাদি।
পরিভ্রমণের জন্য নিসর্গ সহায়তা প্রকল্পের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ট্যুর গাইডের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
 
যোগাযোগের ঠিকানা : নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প, রেমা-কালেঙ্গা সাইট অফিস, চুনারুঘাট উপজেলা, জেলা হবিগঞ্জ। প্রয়োজনে মোবাইল : ০১৭১২-৫৪২৬০৪ অথবা ফোন ০৮৬২৬-৬৯৮।   

ভ্রমণ :: দিনাজপুর।

দিনাজপুরের স্বপ্নপুরী




১৯৮৯ সালে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার আফতাফগঞ্জে  এক মৃত জলাশয়কে পিকনিক স্পটে রূপান্তরিত করে তাতে প্রাণ দেয়া হয়েছে। নাম দেয়া হয়েছে স্বপ্নপুরী। ১৯৯০ সাল থেকে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়। ইচ্ছে হলে আপনি ইট-পাথরের যান্ত্রিক কর্মব্যস্ততা থেকে ক্লান্ত, বিপর্যস্ত দেহ-মনকে এই পিকনিক স্পষ্ট স্বপ্নপুরীতে ক্লান্তি জুড়াতে, আনন্দ-উল্লাস করে বিসর্জন দিতে পারেন মানসিক বিপর্যস্ততাকে। জানতে পারেন জীব-জগতের, উপলব্ধি করতে পারেন আপনজনদের। আত্মপলব্ধির মধ্য দিয়ে বিকাশ ঘটাতে পারেন মানবতার, অবারিত আত্মিক উন্নয়নের দ্বার সভ্যতাকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে পারেন। দেশ-বিদেশের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি এই স্বপ্নপুরী দর্শনে মুগ্ধ হয়েছেন। মোট ৪০০ বিঘা জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে স্বপ্নপুরীর স্বপ্নের জগত। দিনাজপুর সদর থেকে মাত্র ৫২ কিলোমিটার আর ঢাকা থেকে ৩২০ কিলোমিটার দূরত্বে স্বপ্নপুরী অবস্থিত।
সুবিশাল এলাকা, তুলনাহীন প্রাকৃতিক এবং নৈসর্গিক পরিবেশ। সমগ্র এলাকা জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, লিলি, রজনীগন্ধা, গ্লোবাল, কসমস, গাদা-সূর্যমুখী ইত্যাদি ফুলসহ বিভিন্ন প্রকার ঝাউগাছ, ইপিলইপিল, ক্যাকটাস, ওইপেং, ক্রিসমাসট্রি, ঘনসবুজ ঘাসে ঘেরা বাগানের গাছের ডালে বসেছে হাজারো পাখির মেলা, যা প্রকৃতি প্রেমিক সৌন্দর্যপিপাসু পর্যটক ও পরিব্রাজকদের মনোরঞ্জন এবং বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে।
শিক্ষামূলক ভ্রমণ স্বপ্নপুরী পর্যটন কেন্দ্র ছাত্রছাত্রী ও আনন্দ পিপাসুদের জন্য ভিন্ন মাত্রায় সজ্জিত। যার প্রমাণ স্বপ্নপুরীতে রয়েছে শিশু পার্ক, জীবন্ত এবং কৃত্রিম চিড়িয়াখানা।
স্বপ্নপুরীর প্রবেশ দ্বারে দণ্ডায়মান বিশাল আকৃতির দুটি পরীর প্রতিকৃতি যেন পর্যটকদের স্বাগত জানাতে সদা প্রস্তুত।


ঝাউবীথি আর পাম বৃক্ষের মাঝে স্থাপিত মিলেনিয়াম ২০০০-এর প্রতীক। পর্যটকদের নামাজ পড়ার মসজিদ এবং কারুকার্যময় অজুখানা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও জাতীয় কবি নজরুলের ভাস্কর্য। চোখে স্বাপ্নিক বিস্ময়তা আর অন্তরে মুগ্ধতা নিয়ে স্বপ্নপুরীর লেকে স্পিড বোটে জলবিহারে মেতে ওঠা। লেকের ওপরে তৈরি করা হয়েছে কেবল কার। পর্যটকদের গোসল করার জন্য সুসজ্জিত শাপলা ঘাট। সুবিশাল স্বপ্নপুরীর স্থানে স্থানে রয়েছে চমৎকার চমৎকার বিশ্রাম ছাউনি। অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত স্বপ্নপুরী বাগানের ঘনপাতা, লতাগুল্ম উথিত ঢেউ বেষ্টনীর মাঝে বাগান বিলাসের সমারোহ। এ যেন নিপুণ হাতের পরশে বাগ-বাগিচার সৌন্দর্যে পেয়েছে নতুনরূপ। এসব বাগান মন-মননকে করে তোলে আকাশচারী ও স্বপ্নময়। স্বপ্নপুরীর রাস্তাগুলো একেকটি এক অভিন্ন। একটি রাস্তার দুই পাশে উদ্বাহু হংসমিথুনের দল। আরেকটি রাস্তার দু’পাশে মাছ আকৃতির ফুলের টপ দিয়ে সাজানো হয়েছে। কৃত্রিম চিড়িয়াখানায় প্রবেশের জন্য তৈরি করা হয়েছে চোখ ধাঁধানো রাস্তা। জীবন্ত চিড়িয়াখানায় প্রবেশের প্রধান ফটকটি বাংলার ঐতিহ্য, বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মুখাকৃতির এ ফটক পর্যটকদের শিহরিত করে ও রোমাঞ্চিত করতে প্রস্তুত।






বাংলাদেশের কলা গাছের অনুুরূপ অতিথি বৃক্ষ পান্থপথ। দুর্লভ এ বৃক্ষ স্বপ্নপুরীর জীবন্ত চিড়িয়াখানায় সংযোজন করেছে নতুন সৌন্দর্য মাত্রা। সব মিলিয়ে বলা যায় কোন পর্যটক যদি একবার স্বপ্নপুরীতে যান তাহলে সত্যি স্বপ্নের মাঝে হারিয়ে যাবেন। নিজেকে পশ্ন করবেন, এটা আমি কোন জগতে এসেছি।
প্রবেশ মূল্য বাস-মিনিবাস (যাত্রীসহ) ৪০০ টাকা।
মাইক্রোবাস-পিকআপ (যাত্রীসহ) ২০০ টাকা। কার-জিপ টেক্সিক্যাব যাত্রীসহ ১০০ টাকা। গাড়ি ছাড়া গেলে জনপ্রতি ২০ টাকা।




স্বপ্নপুরীর বাংলো ভাড়া নীলপরী ৩০০ টাকা (প্রতি ডবল রুম), রজনীগন্ধা ৪০০ (প্রতি ডবল রুম), নিশি পদ্ম ১৫০০ টাকা (তিন রুমসহ বাংলো), চাঁদনী ৫০০ টাকা (প্রতি ডবল রুম), সন্ধ্যা তারা ১০০/১৩০০ টাকা (প্রতি ডবল নন এসি ও এসি রুম)
ঢাকা থেকে বুকিং ব্যবস্থা ঢাকা থেকেও স্বপ্নপুরীর মোটেল বা বাংলো বুকিংয়ের সুবিধা আছে। ঠিকানা : হোটেলের সফিনা, ১৫২ হাজী ওসমান গনি রোড, আলুবাজার ঢাকা। ফোন : ৯৫৫৪৬৩০-৯৫৬২১৩০।
স্বপ্নপুরীতে রয়েছে অল্প দামে খাবারের ব্যবস্থা : ভাত, সবজি, ডি, ডাল ১৫ টাকা, ভাত, সবজি, মাছ, ডাল ২০ টাকা ও ভাত, সবজি মুরগি, ডাল ৩০ টাকা।
এছাড়াও স্বপ্নপুরীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা পর্যটন সুবিধা দিতে একটি আধুনিক হোটেল, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে স্বতন্ত্র স্পট, পাখির রাজ্য, বেলকার, রোপকার, মানবিক চৈতন্যে ভাস্কর্য শিল্প ইত্যাদি নির্মাণের পরিকল্পনা মোতাবেক, যার নির্মাণ কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। স্বপ্নপুরী ভ্রমণে সব ভ্রমণ পিপাসুকে আমন্ত্রণ। 


ভ্রমণ :: ঝিনাইদহ , মল্লিকপুর।

মল্লিকপুরের এশিয়ার বৃহত্তম বটগাছ



ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মালিয়াট ইউনিয়নের অমতর্গত বেথুলী গ্রামের উত্তর-পশ্চিম কোণে বটগাছটি অবসিহত। কালীগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ১০ কিঃ মিঃ পূর্বদিকে কালীগঞ্জ-আড়পাড়া-খাজুরা সড়কের ত্রিমোহনী সংলগ্ন স্থানে এ প্রাচীন বটগাছের অবস্থান। অনেক প্রজাতির ছোট-বড় গাছ আছে বাংলাদেশে। যে সব গাছ বিশালকায় ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে তন্মধ্যে বটগাছ বিশেষ উল্লেখযোগ্য
বটগাছ Moraceae গোত্রের চির সবুজ সুবৃহৎ বৃক্ষ, Ficus bengalensis ছড়ানো শাখা থেকে ঝুরি মাটিতে নেমে আসে ও ক্রমে কান্ডের আকারে সতম্ভমূলে রুপান্তরিত হয়। বয়স্ক বটগাছ বিশালাকৃতির আচ্ছাদন তৈরী করে বিসতীর্ণ এলাকাজুড়ে বিস্তার লাভ করে। বাংলাদেশের সর্বত্র বটগাছ জন্মে। ফল ছোট, গোলাকার, পাঁকলে লাল হয়। বটগাছকে পবিত্র বলে গণ্য করে হিন্দুরা।
বটগাছ মানুষের তৈরী কোন পুরাকীর্তি নয়। ইহা একটি বৃক্ষ, প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রকৃতির অবদানে এই বটগাছ জন্মে। সেজন্য ইহাকে প্রাকৃতিক পুরার্কীর্তি বলা যায়। ঝিনাইদহের অধিকাংশ লোক এ বটগাছের নাম জানেন। একারণে ইহাকে পুরাকীর্তি শ্রেণীভুক্ত করে বৃক্ষটির বৃত্তান্ত এখানে তুলে ধরা হলো। বটগাছের কাঠ বেশী একটা গুরতত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু এ বৃক্ষের আকার হয় বিশালকায়। কাঠ ধূসর, মাঝারি রকমের শক্ত। সতম্ভমূলের কাঠ গুঁড়ির কাঠের তুলনায় বেশি মজবুত এবং তাবুর খুঁটি, পালকির ডান্ডা ও সসতা আসবাবপত্রে ব্যবহার্য। বিরাটকায় বটবৃক্ষ পথিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অতি সহজে। বৃহত্তম এই বটগাছ ঝিনাইদহের একটি গৌরব। এ গাছ এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম গাছ বলে সনাক্ত করা হয়েছে।
এ বটগাছের অবস্থান ও নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি ও কিংবদন্তি। কারো কাছে সুইতলার বটগাছ, কারো কাছে সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছ। আবার কারো কাছে বেথুলী বটগাছ বলে পরিচিতি। প্রকৃত পক্ষে এর অবস্থান হলো বেথুলী মৌজায়। বেথুলী মৌজায় এর অবস্থান হলেও সে সময় এলাকায় তেমন জনপদ গড়ে উঠেছিল না। পথশ্রান্ত লোকজন বটগাছের নীচে বসে বিশ্রাম করতো, সময় কাটাতো। এজন্যই মল্লিকপুর গ্রামের কতিপয় ব্যক্তি বটতলার পার্শ্বে দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করে। মল্লিকপুরের ব্যবসায়ীদের ব্যবসা কেন্দ্র নামেই মল্লিকপুরের বটগাছ পরিচিত লাভ করে।
প্রায় ২৫০ বছর আগে এই গাছের উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য জানা যায় না। এলাকার বয়োবৃদ্ধদের নিকট হতে জানা যায়, একটি কুয়ার পাশে ছিল এ গাছের মূল অংশ। তখন জনবসতি ছিল খুবই কম। রাস্তার ধারের এ গাছটি ডাল পালা ও পাতায়পূর্ণ। গাছের নীচে রোদ বৃষ্টি পড়তো না। মাঘের শীতের রাতেও গাছ তলায় গরম লাগতো। গ্রীষ্মকালে গাছের তলা ঠান্ডা থাকতো। পথিকরা গাছতলায় শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিতো। সরেজমিনে গিয়ে জানা যায় বাস্তবে এ এলাকায় সুইতলা নামক কোন স্থানের অস্থিত্ব নেই। বয়োবৃদ্ধদের ধারণা পথশ্রান্ত পথিকরা এই মনোরম স্থানে শুয়ে বসে বিশ্রাম নিতো, তখন থেকেই অনেকের কাছে সুইতলা বটগাছ বলে পরিচিতি লাভ করে। সেখান থেকেই নামকরণ হয় সুইতলা বটগাছ।
তবে বটগাছটির জন্ম যে কুয়ার পড়ে সেই কুয়া কোথায় এবং কে খনন করেন তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। কারো মতে, যে স্থানে কুয়া ছিল ঐ জায়গাটি ১৯২৬ সালে রেকর্ডের পূর্বে নাকি বেথুলী গ্রামের ভূষণ সাহাদের পরিবারের কারো নামে রেকর্ড ছিল। বর্তমানে পুরোটাই সরকারের খাস জমির অন্তরভুক্ত।
কুয়ার পাড়ের সেই বটগাছটি কালত্রুমে ¡¥ঝুরি' (সহানীয়ভাবে ¡§বোয়া' বলা হয়) নেমে নেমে পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহ দখল করে নিয়েছে। মূল গাছটি কালত্রুমে অনেকগুলো ছোট গাছে বিভক্ত হয়ে গেছে। মোট ৪৫টি উপবৃক্ষ ও ১২ দাগে প্রায় ১১ একর (২.৩৩ হেক্টর) জমি দখল করে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ বটগাছটি। দক্ষিণ-পূর্ব পাশের গাছ গুলো জমাটবদ্ধ এবং উত্তর-পশ্চিম পাশে কিছুটা ফাঁকা ছাউনি দিয়ে বেষ্টিত। গাছটির ৩৪৫টি ঝুরি মাটির সাথে সংযুক্ত এবং ৪০টি ঝুরি ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। মূলগাছ এখন আর নেই। মাঝখানে কিছু অংশ ফাঁকা এবং চারপাশে শাখা-প্রশাখায় বেষ্টিত। বটগাছটির বয়স আনুমানিক ২০০ থেকে ২৫০ বছর।
এ বটগাছকে কেন্দ্র করে পার্শ্বেই বাংলা ১৩৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত বেথুলি বা মল্লিকপুরের বাজার। ত্রুমে ত্রুমে বাজারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বর্তমানে অনেকগুলো সহায়ী দোকান আছে এ বাজারে। প্রতি শনিবারে ও বুধবারে সাপ্তাহিক হাট বসে। দূরদূরামত হতে লোকজন এসে সওদা করে। বৃদ্ধদের মতে, দিনের বেলায়ও গভীর ছায়া হয়ে থাকতো বটতলা। এখানকার অধিকাংশ সম্পত্তিই ছিল রায়গ্রামের জোতদার নগেন সেনের সস্ত্রী শৌলবালা সেন -এর নামে। পরবর্তীতে খাস হয়ে যায়। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে অনেক লোক রোগব্যাধি মুক্তির আশায় এ গাছের নামে মান্নত করে। এ বিশাল বটবৃক্ষে সব সময় পাখি বসে, কিচির মিচির শব্দ লেগেই থাকে। অথচ গাছে কোন পাখি বাসা বাঁধে না। কোন দিন কেউ শকুন বসতে দেখেনি। গাছের নীচে পশুপাখি বা প্রাণীর মল-মূত্র দেখা যায় না। বটতলায় কালীপূজার একটি সহায়ী পাঁকা বেদী নির্মিত হয়েছে। চাপরাইল গ্রামের গৌরপদ অধিকারী ও হাজারী লাল অধিকারীর আর্থিক সহায়তায় এ বেদী নির্মিত হয়। এ বেদিতে সাড়ম্বরে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বে এ গাছতলায় ১৫ দিন ব্যাপী রাসপূজা অনুষ্ঠিত হতো এবং এ উপলক্ষে মেলা বসতো।
১৯৮২ সালের পূর্ব পর্যমত এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম বটগাছ বলে পরিচিত ছিল কলকালাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনের বটগাছটি। এ গাছটির আচ্ছাদন ২.২২ একর জমি জুড়ে। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালের বিবিসির এক তথ্য অনুসন্ধানে প্রতিবেদনে প্রচারিত হয় যে, কালীগঞ্জ উপজেলার বেথুলী মৌজায় অবস্থিত সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছ কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনের (শিবপুর) গাছ অপেক্ষা বড় এবং ইহা এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছ। ¡¥বাংলাপিডিয়া'- গ্রমেহ সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছটিকে ¡§বিশ্ববট' (The Great Banyan) বলা হয়েছে। ২.৩৩ হেক্টর এলাকা নিয়ে এ গাছের বিসতৃতি।
অযত্ন, অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং নানামুখি অত্যাচারের কারণে এ ঐতিহ্যবাহী বটগাছের অস্তিত্ব আজ প্রায় বিলিন হতে চলেছে। মল্লিকপুর গ্রামের বেলায়েত হোসেন মিয়া জীবিত থাকাকালীন এ গাছ দেখাশুনা করতেন স্বেচ্ছায়। যে কারণে তিনি এ বটবৃক্ষের কাছে সর্ব প্রথম দোকান দেন এবং বাজার প্রতিষ্ঠিত করেন।
মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছের ঐতিহাসিক দিক বিবেচনা করে অনেক স্থান থেকে প্রতিনিয়ত দর্শনার্থী এখানে আসেন। এ গুরত্ব বিবেচনা করে ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ বটবৃক্ষের পাশে ১০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে একটি রেষ্ট হাউস নির্মাণ করেন ১৯৯০ সালে। এ জন্য বটগাছের পার্শ্বে অবস্থিত ১৬৯ মৌজার ১৬ নং দাগের .৩২ শতক জমি মল্লিকপুর গ্রামের জহর আলী বিশ্বাসের সস্ত্রীক মোছাঃ কুণ্টি বিবি ১৯৯০ সালের ২৫ শে এপ্রিল ঝিনাইদহ জেলা পরিষদের নামে দানপত্র লিখে দেন। বটবৃক্ষ সংরক্ষণের জন্য ইহার চারদিকে দেয়াল দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রকৃতিতে এবং মানুষের জীবনে একটা দিক আছে শান্ত এবং স্নেহশীল, এ বটগাছ যেন তারই মূর্ত প্রতীক। দুপুরের তপ্ত রোদে পথিকদের আশ্রয় দেয়, ছায়া দেয় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত পথচারীদের। প্রখর খরতাপ ও প্রবল ঝড়-বৃষ্টির সময় পাখিদের আশ্রয় দেয় এ গাছ। সবার উপকার করার জন্যই যেন দাঁড়িয়ে আছে এ প্রাচীন বটগাছ।
বিশ্বব্যাপী গাছটির পরিচিতি ঘটে ১৯৮২ সালে বি,বি,সিƒuk সংবাদ ভাষ্যের মাধ্যমে গাছটি এ এলাকার আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে। বহু দেশী-বিদেশী পর্যটক এখানে আসে। তবে বটগাছটির প্রতি নেই কোন সচেতন পরিচর্যা। অযত্ন, অবহেলা ও অত্যাচারে বিলীন হতে চলেছে গাছটি। প্রতিনিয়ত কাটা হচ্ছে এর ডালপালা।
বট গাছটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করেও পর্যটকদের সুবিধার্থে এখানে ১৯৯০ সালে সরকারি অনুদানে নির্মিত হয়েছে একটি রেষ্ট হাউজ।

বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৪

ভ্রমণ :: বাংলাদেশের তাজমহল।

আমাদের তাজমহল





সম্রাট ঈশা খাঁর রাজধানী নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের সঙ্গে দু’বছর আগে যুক্ত হয় আর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ভারতের আগ্রায় সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক নির্মিত তাজমহলের অনুকরণে সোনারগাঁওয়ের পেরাব নামক স্থানে বেসরকারি উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে একটি তাজমহল সদৃশ স্থাপনা। এটিকে বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় তাজমহল বলে দাবি করেছেন এর প্রতিষ্ঠাতা। নাম দিয়েছেন বাংলার তাজমহল।
২০০৫ সালে তাজমহল নির্মাণকাজ শুরু হয়।
পঞ্চাশ টাকা প্রবেশ ফি’র বিনিময়ে গত ২০০৮ সালের ঈদুল আজহার দিন থেকে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় এটি। তারপর থেকে দর্শনার্থীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন এখানে। 

কিভাবে যাবেন? 

ঢাকা থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটারের দূরত্বের বাংলার তাজমহলে ঢাকা-সিলেট অথবা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে খুব সহজেই যাওয়া যায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে কুমিল্লা, দাউদকান্দি অথবা সোনারগাঁওগামী যে কোনও গাড়িতে চড়ে মদনপুর বাসস্ট্যান্ডে নামতে হয়। সেক্ষেত্রে ভাড়া লাগে ১৫ টাকা। সেখান থেকে সিএনজি বা স্কুটারে জনপ্রতি ২৫ টাকা ভাড়ায় সহজেই যাওয়া যায় তাজমহলে। অন্যভাবে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে ভৈরব, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জগামী যে কোনও গাড়িতে চড়ে বরপা বাসস্ট্যান্ডে নামতে হয় সেক্ষেত্রে ভাড়া হবে ২০ টাকা এখান থেকে সিএনজি স্কুটারে জনপ্রতি ১০ টাকা ভাড়ায় পৌঁছে যেতে পারেন তাজমহলে।  


তাহলে আর দেরি কেন? ঘুরে আসুন বাংলার তাজমহল। 

ধন্যবাদ সবাইকে। 


ভ্রমণ :: ফুরামন চূড়া , রাঙ্গামাটি।


আকাশে মেঘ ছিল, বৃষ্টি ছিল না। ভাপসা গরম ছিল, বাতাস ছিল না। এমনি এক আবহাওয়ার মাঝে আমাদের ফুরামন অভিযান শুরু হলো সাপছড়ি থেকে। রাঙামাটি শহরের বনরূপা বাজার থেকে বেরোতেই বেলা গেল ঢলে। এখানকার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়চূড়ায় ওঠার এ অভিযাত্রায় আমার সঙ্গী ইশান দেওয়ান। তবলছড়ির চাকমা এ ছেলের সঙ্গে ফুরামনে ওঠার দারুণ এক অনুপ্রেরণা পেলাম। সাপছড়ি থেকে ঘণ্টা দেড়েক হাঁটার পর ফুরামন পাহাড়ের মূল অংশে উঠে পড়লাম আমরা। ক্রমে যতই ওপরে উঠতে থাকলাম, কাপ্তাই লেক, রাঙামাটি শহর আর চারদিকের নির্জন পাহাড়ি এলাকা দুচোখের সামনে উদ্ভাসিত হতে লাগল অপরূপ শোভা নিয়ে। 
এ বছরের শুরুর দিকে একবার ফুরামন চূড়ায় উঠেছিলাম। তবে সময়টা শীতকাল থাকায় মনটা ভরাতে পারেনি ফুরামন। বর্ষাকালে এই পাহাড় চূড়ায় উঠে চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার নাকি মজাই আলাদা! দূরের কাপ্তাই লেক পাহাড়ের মাঝে নীলাভ জলরাশি নিয়ে নীরবে গিয়ে যায় সম্প্রীতির গান। রাঙামাটি শহরটিও যেন লেকের মাঝে ছড়ায় সৌন্দর্যের মুক্তা। আর দূরের পাহাড়ের ভাঁজগুলো টেনে ধরে দুচোখের চাহনি। বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। প্রথমবারের মতো সেবার যাই লেক-পাহাড়ের শহর রাঙামাটি। শুভলং থেকে ফেরার পথে কাপ্তাইলেকে এসে আমার দু’চোখ আটকে যায় ফুরামনের চূড়ায়। কী জাদুকরি দহরম-মহরম মেঘের সঙ্গে তার! মেঘের দল অনুপম মায়ায় আলতো করে আদর করে যায় ফুরামনের চূড়া। দেখে বিস্ময়ের শেষ ছিল না আমার! তখন অবশ্য ফুরামনের সঙ্গে পরিচয় হয়নি আমার। নামও জানতাম না তার।
বছর খানেক আগে ফটোসাংবাদিক ছন্দসেন চাকমার কাছে এ পাহাড়ের খোঁজ পাই। তারপর এক শীতের রাতে বেরিয়ে পড়ি রাঙামাটির উদ্দেশে। মানিকছড়ি থেকে জগদীশ চাকমা ও হৃত্বিক কালাই আমার সঙ্গে যোগ দেন। সেবারের যাত্রা ছিল সাপছড়ি থেকে পায়ে হাঁটার ট্রেইল ধরে। ফুরামনে ওঠার কয়েকটা পথ আছে। এবার ট্রেকিংয়ের সময়টা বর্ষাকাল থাকায় গাড়ি ওঠার পথটাকেই বেছে নিতে হলো। এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, যাঁরা ট্রেকিংয়ের জন্য শুধু বান্দরবানকে আদর্শ জায়গা বিবেচনা করেন, তাঁদের ফুরামন দেবে নতুন বৈচিত্র্যের স্বাদ।
বর্ষাকালে পাহাড়ের গাছপালা আর জঙ্গলগুলো সজীব-সতেজ। রাস্তার পাশের সেগুনগাছের বড় বড় পাতা বাতাসের সঙ্গে দোল খেয়ে দারুণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। শীতকালে আবার এসব সেগুনগাছ পাতাবিহীন ন্যাড়া কঙ্কালের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু সেগুনগাছ কেন, পাহাড়গুলোই তো হয়ে পড়ে মলিন-বিবর্ণ। বিকেল বেলায় সাঁঝের ঝিঁঝি পোকার মতো নানা কীটপতঙ্গের গান শোনা যায়। এ যেন অন্য এক দুনিয়া।
ফুরামনের একেবারে চূড়ায় গৌতম বুদ্ধের মূর্তি। আর পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ধ্যানঘর। এ পাহাড়েই অবস্থিত আন্তর্জাতিক বনবিহার ভাবনাকেন্দ্র। বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কাছে সাপছড়িতে অবস্থিত বিশাল আকারের এ পাহাড়ের গুরুত্ব অনেক। পর্যটকেরা আসেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে, চূড়ার ওপর থেকে কাপ্তাই লেকের নৈসর্গিক রূপে হাবুডুবু খেতে। চাকমা ভাষায় ফুরামন শব্দের অর্থ শেষ পাহাড়। অর্থাৎ সবচেয়ে উঁচু চূড়া। রাঙামাটি সদর উপজেলার এটিই সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। অবশ্য এর উচ্চতা নিয়ে আছে দ্বিমত। কেউ বলেন, ফুরামনের উচ্চতা এক হাজার ৮০০ ফুটের বেশি হবে না। তবে দুই হাজার ফুট উচ্চতা টিংকু ট্রাভেলারের জিপিএসে ধরা পড়ে। 

গাড়ি ওঠার রাস্তার শেষ প্রান্তে পেয়ে গেলাম কিয়োং অর্থাৎ বনবিহার। সেখানে আছে একটা প্রার্থনাঘর। কঠিন চীবরদানের সময় এই জায়গাটা বেশ জমে ওঠে। এখানে আছে পাঁচ থেকে ছয়টি ধ্যানঘর। যেগুলোর কোনোটি পাহাড়ের পাদদেশে, কোনোটি আবার পাহাড়ের মাথায়। কিয়োং ছেড়ে আরও কিছুটা নিচে নামলে পাওয়া যায় রন্ধনশালা।
কিয়োং চূড়ায় ওঠার বাকি পথের পুরোটাই সিঁড়ি। মিনিট বিশেক লাগে এ সিঁড়িপথে। গাইড ইশান দেওয়ান সিঁড়ি গুনে ৩৮২টি সিঁড়ি থাকার কথা জানালেন। ফুরামনের চূড়ার পরিসর খুব বেশি না। এখান থেকে পুরো দুনিয়াটাই যেন চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ভাসমান মেঘের সঙ্গে পাহাড়ের লুকোচুরি খেলা দেখার যেন এটাই উত্তম জায়গা। কাপ্তাই লেক আর আট-দশ কিলোমিটার দূরের রাঙামাটি শহরটিকে বেশ কাছেই বলে মনে হয় এই চূড়া থেকে। বরকল, নানিয়ারচর, জুরাইছড়ি আর কাপ্তাই উপজেলার পাহাড়ের ভাঁজগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকে নান্দনিক রূপ নিয়ে। এমনকি বহু দূরের কর্ণফুলী নদীও এখান থেকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। 
রাঙামাটি শহর ও কাপ্তাইলেকের অবস্থান ফুরামনের পূর্ব দিকে। তাই এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে দুপুরের পর ট্রেকিং করা ভালো। আর খুব সকালে পৌঁছতে পারলে মেঘ-পাহাড়ের অনুপম সম্পর্ক উপভোগ করা যায় অনায়াসে।
সূর্যের তেজ কমে এল ক্রমেই। আর আমাদের ফেরার তাড়নাও বাড়ল সেই সঙ্গে। ফেরার পথেই নেমে এল গৌধূলির আলো, তারপর অন্ধকার। কীটপতঙ্গের গুঞ্জন সন্ধ্যার নীরবতা ভেঙে দিয়ে পাহাড়ি পথে আমাদের চলার গতিতে এনে দিল বেগ। 

যেভাবে যাবেন
ঢাকার কলাবাগান, কমলাপুর ও ফকিরাপুল থেকে এস আলম, হানিফ, শ্যামলী, সেন্টমার্টিন পরিবহন, ডলফিনসহ বেশ কিছু পরিবহনে রাঙামাটি যাওয়া যায়। ফুরামনে যেতে হলে মানিকছড়িতে নামা ভালো। শহরে নামলে পুনরায় মানিকছড়ি আসতে হবে অটোরিকশায়। ট্রেকিং করতে চাইলে সঙ্গে একজন গাইড নিয়ে সদলবলে বেরিয়ে পড়ুন। আর গাড়িতে যেতে চাইলে রিজার্ভ করুন। চাঁদের গাড়ি বা জিপ কেবল মানিকছড়িতেই পাওয়া যায়। ভাড়া দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। 



ধন্যবাদ,  ভালো থাকবেন আর সময় পেলে ঘুরে আসুন।  

শুক্রবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৪

ভ্রমণ :: রাজশাহী ।

ঘুরে আসুন রাজশাহী





আমের মৌসুমে রাজশাহীতে দর্শনীয় জায়গাগুলো বেড়ানোর সঙ্গে আম খাওয়ার বাড়তি সুযোগ মিলবে। দুএক দিনের সময় নিয়ে তাই  ঘুরে আসুন রাজশাহী থেকে।

রাজশাহী শহর
পদ্মার তীরে অবস্থিত প্রায় ৯৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিভাগীয় শহর রাজশাহী। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ শহরের উত্থান। আগে এ জেলার সদরদপ্তর ছিল নাটোরে। ১৮২৫ সালে সেটি নাটোর থেকে রাজশাহীতে স্থানান্তরিত হয়। রেশম উৎপাদন কেন্দ্র এবং পদ্মা নদীর তীরবর্তী শহর হওয়ায় ইংরেজ বণিকদের সহজেই নজর কাড়ে রাজশাহী।
পর্যায়ক্রমে ওলন্দাজ, ফরাসি, ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে এ শহরে। ওলন্দাজ রেশম কারখানার ভবনটি ছিল বড়কুঠি নামে পরিচিত। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইউরোপীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদর দফতর বসেছিল বড়কুঠিতে।
উনিশ শতকের শেষ দিকে বড়কুঠি ব্রিটিশদের কাছ থেকে মেদিনীপুর জমিদার কিনে নেয়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর একে বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের গুদামঘর করা হয়। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বড় কুঠি হয় ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবন ও কার্যালয়।
শহরের প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলো হল: শাহেববাজর, রানীবাজার, রেশমপট্টি, ঘোড়ামারা, হাতেমখানা, দরগাপাড়া, কুমারপাড়া, বোয়ালিয়া ইত্যাদি। ১৮৭৬ সালে রাজশাহী পৌরসভা ও ১৯৯১ সালে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয় রাজশাহী শহর। 

রাজশাহী ভ্রমণের শুরুতেই দেখে দিন বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। এ অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা মিলবে। রাজশাহী সদর হাপতালের সামনে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন সংগ্রহশালা বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর।
নাটোরের দিঘাপাতিয়ার জমিদার শরৎ কুমার রায়, আইনজীবি অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রামাপ্রসাদ চন্দ্র- পুমখ ব্যক্তির প্রচেষ্টায় ১৯১০ সালে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত। ১৯১৬ সালে মূল জাদুঘর ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল। ১৯৬৪ সালে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের দায়িত্ব বর্তায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।
আটটি গ্যালারিতে প্রায় দেড় হাজার প্রস্তর ও ধাতব মূর্তি, দুই হাজারেরও বেশি প্রাচীন মুদ্রা, প্রায় এক হাজার পোড়ামাটির ফলক ছাড়াও হাজারো নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে এ জাদুঘরে।
এপ্রিল থেকে অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত, নভেম্বর থেকে মার্চ সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শুক্রবার খোলা থাকে দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষিত ছুটির দিনে এটি বন্ধ থাকে।  
শাহ মখদুমের (র) সমাধি
রাজশাহী সরকারী কলেজের কাছে দরগা পাড়ায় রয়েছে এ অঞ্চলের দরবেশ পুরুষ শাহ মখদুমের (র) সমাধি। ১২৮৭ সালে তিনি বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এ অঞ্চলে আসেন। ১৩১৩ সালে চিরকুমার এ দরবেশ মৃত্যুবরণ করেন। আলীকুলী বেগ ১৬৩৫ সালে তার সমাধির উপরে এক গম্বুজ বিশিষ্ট সৌধ নির্মাণ করেন। প্রতিবছর আরবী মাসের ২৭ রজব এখানে উরস অনুষ্ঠিত হয়। আর ১০ মহররম এখান থেকে বের হয় তাজিয়া মিছিল।
টি বাঁধ
রাজশাহী শহরের পাশে পদ্মার তীরে ইংরেজি ‘টি’ আকৃতির বাঁধ এখন শহরের অন্যতম বেড়ানোর জায়গা। পদ্মার শীতল বাতাসের পরশ নিতে প্রতিদিন বহু মানুষ এখানে জড়ো হন। পদ্মায় এখন পানি এসেছে। এখান থেকে নৌকা ভাড়া করে তাই ঘুরে আসতে পারেন পদ্মার কোনো চর। 
বিসিক শিল্প এলাকা
শহরের বিসিক শিল্প এলাকায় আছে বেশ কিছু রেশম শিল্প। পোকা থেকে রেশম তৈরির কলাকৌশল দেখতে পাবেন এখানে। তুলনামুলক কম দামে এখান থেকে রেশমের কাপড়ও কেনা যায়।
স্মৃতি অম্লান
শহীদ ক্যাপ্টেন বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর সড়কের দ্বীনেভদ্রা এলাকায় মহান মুক্তিযুদ্ধের এ স্মৃতিসৌধ। রাজশাহীর কেন্দ্রস্থলে নির্মিত ১৯৯১ সালের ২৬ মার্চ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। স্থপতি রাজিউদ্দিন আহমদ।
সৌধে মোট তিনটি স্তম্ভ আছে। প্রতিটির গায়ে ২৪টি করে ধাপ। যেগুলোতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আন্দোলনের ক্রমবিবর্তন ও স্বাধীনতার ফসল। মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের নির্দেশ করা হয়েছে স্তম্ভের গায়ের  ৩০টি ছিদ্রের মাধ্যমে। প্রতিটি স্তম্ভে রয়েছে ১০টি করে ছিদ্র।
বেদিমূলে রাখা আছে নীল শুভ্রপাথরের আচ্ছাদন। যা দুই লাখ নির্যাতিত নারীর বেদনাময় আর্তির কথা ইঙ্গিত করে। সৌধের চূড়ায় রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্রের লালগোলক। যা স্বাধীনতা যুদ্ধের উদীয়মান লাল সূর্যের প্রতীক।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
রাজশাহী শহরের পাশে অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। এর ছায়া ঘেরা ক্যাম্পাসে বেড়াতে ভালো লাগবে সবার। 
সাবাশ বাংলাদেশ
মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারক ভাস্কর্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার সবুজ চত্বরে মুক্তাঙ্গনের উত্তরপাশে অবস্থিত। রাকসু এবং দেশের ছাত্রজনতার অর্থ সাহায্যে শিল্পী নিতুন কুন্ড এই ভাস্কর্যটি বিনা পারিশ্রমিকে নির্মাণ করেন। 
১৯৯২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ‘সাবাশ বাংলাদেশ’ উদ্বোধদন করেন। এই স্মৃতিস্তম্ভে আছে দুজন মুক্তিযোদ্ধার মূর্তি। একজন অসম সাহসের প্রতীক, অন্য মুক্তিযোদ্ধার হাত বিজয়ের উল্লসে মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে পতাকার লাল সূর্যের মাঝে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী যে কোনো বাসে চড়ে পুঠিয়া নামা যায়। রাজশাহী থেকে পুঠিয়ার দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে নাটোরগামী বাসে চড়ে আসতে হবে পুঠিয়া। ভাড়া ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশপথে রাজশাহী যাওয়া যায়। ঢাকার কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে গ্রীন লাইন ও দেশ ট্রাভেলসের এসি বাস যায় রাজশাহী। ভাড়া ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা।
এছাড়া ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে শ্যামলি পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ন্যাশনাল ট্রাভেলস, বাবলু এন্টারপ্রাইজ প্রভৃতি পরিবহনের বাস রাজশাহী যায়। ভাড়া ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকা।
ঢাকার কমলাপুর থেকে রোববার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন সিল্কসিটি এক্সপ্রেস।
মঙ্গলবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ১১টা ১০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পদ্মা এক্সপ্রেস।
ভাড়া এসি বার্থ ৯৪০ টাকা। এসি সিট ৬৩০ টাকা। স্নিগ্ধা ৫২৫ টাকা। শোভন চেয়ার ৩১৫ টাকা।
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইউনাইটেড এয়ারের বিমান যায় রাজশাহীতে।
থাকার জায়গা
পুঠিয়ায় পর্যটকদের থাকার ভালো ব্যবস্থা নেই। ভ্রমণে গেলে রাত যাপন করার জন্য রাজশাহীই ভালো জায়গা। এ শহরে থাকার জন্য বিভিন্ন মানের বেশ কিছু হোটেল আছে। এসব হোটেলে ২শ’ থেকে ৪ হাজার টাকায় বিভিন্ন মানের রুম পাওয়া যাবে।
অন্যতম হোটেলগুলো হল: রাজশাহী চিড়িয়াখানার সামনে পর্যটন মোটেল, সাহেব বাজারে হোটেল মুক্তা ইন্টারন্যাশনাল, বিন্দুরমোড় রেল গেইটে হোটেল ডালাস ইন্টারন্যাশনাল, গণকপাড়ায় হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল, মালোপাড়ায় হোটেল সুকর্ণা ইন্টারন্যাশনাল, সাহেব বাজারে হামিদিয়া গ্রান্ড হোটেল, শিরোইলে হকস্‌ ইন, লক্ষীপুর মোড়ে হোটেল গ্যালাক্সি, সাহেব বাজারে হোটেল নিউ টাউন ইন্টারন্যাশনাল। 


সময় করে  ঘুরে আসবেন। ধন্যবাদ। 


ভ্রমণ :: ঈদের ছুটিতে কক্সবাজার !!!

ঈদের ছুটিতে কক্সবাজার 




বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ সমুদ্র সৈকতে ঈদের ছুটিতে পর্যটকদের ভিড় থাকে। তাই নীল জলের হাতছানিতে সাড়া দিতে আগেভাগেই সেখানকার হোটেল, যাতায়াত ইত্যাদির আগাম ব্যবস্থা করে ফেলা উচিত।
ঋতু হিসেবে ঈদের ছুটি বর্ষাকালে না হলেও, এই মৌসুমে সমুদ্র সৈকতে পর্যটকরা বৃষ্টি উপভোগ করতে পারবেন। এ সময়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত একটু ভিন্ন আমেজেই থাকে। অন্যান্য সময়ের চেয়ে এখন সমুদ্র সবসময়ই একটু উত্তাল, ঢেউগুলোও তাই বেশ বড় বড়।
কক্সবাজার ভ্রমণে বেড়ানোর প্রধান জায়গা সমুদ্র সৈকত। বালুকাবেলায় চেয়ারে গা এলিয়ে বসে সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ দেখে হারিয়ে যেতে পারেন অজানা কোনো ভূবনে।
এ সময়ে সমুদ্রে না নামাই ভালো। আর নামলেও খুব সাবধানতা অবলম্বন করুন। সৈকতে লাল পতাকা নির্দেশিত সময় অর্থাৎ ভাটার সময় কখনোই সমুদ্র স্নানে যাবেন না। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় সমুদ্র সৈকতে বেড়ানো মিস করবেন না।
সৈকত ছাড়াও কক্সবাজারে বেড়াতে পারেন হিমছড়ি, ইনানী, রামু কিংবা ডুলাহাজরা।
হিমছড়িতে পাহাড় আর সমুদ্রের মিতালি। আরো আছে হিম শীতল ছোট ছোট পাহাড়ি ঝরনা। হিমছড়ি যাওয়ার জন্য ব্যাটারি চালিত রিকশা, অটোরিকশা কিংবা জিপ আছে। কক্সবাজার থেকে হিমছড়ির দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। সেখান থেকে আরও প্রায় আট কিলোমিটার সামনে গেলে আছে ইনানী সমুদ্র সৈকত। এ সৈকতের সঙ্গে সেন্টমার্টিনের সৈকতের অনেকটা মিল আছে। এক দিনেই জায়গা দুটি বেড়ানো যায়।
কক্সবাজার শহরের পার্শ্ববর্তী থানা রামুতে আছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বেশ কিছু কেয়াং ও প্যাগোডা। সন্ত্রাসীদের হামলায় নস্ট হয়ে যাওয়া এসব মন্দিরগুলো আবারও নতুন আঙ্গিকে আরও আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা হয়েছে। দেখে আসতে পারেন এসব মন্দিরগুলো। 
এছাড়া চকোরিয়ার ডুলাহাজরায় আছে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক। সেখানে গিয়েও দেখে আসতে পারেন নানান বন্যপ্রাণী। প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খোলা থাকে ডুলাহাজরার এ সাফারি পার্ক। কক্সবাজারের কলাতলী থেকে জিপে কিংবা মাইক্রোবাসে জায়গা দুটিতে যাওয়া যায়।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক ও আকাশ পথে সরসরি কক্সবাজার যাওয়া যায়। এ পথে গ্রীন লাইন, সৌদিয়া, সোহাগ, হানিফ, টি আর ইত্যাদি পরিবহন সংস্থার এসি বাস চলাচল করে। ভাড়া ১ হাজার ৬শ’ টাকা ২ হাজার ৫০ টাকা। এছাড়া এস আলম, সৌদিয়া, শ্যামলী, ইউনিক, ঈগল, হানিফ, ইত্যাদি পরিবহনের নন এসি বাসও চলে এ পথে। ভাড়া সাড়ে ৭শ’ থেকে সাড়ে ৮শ’ টাকা।
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে থেকে ইউনাইটেড এয়ার, রিজেন্ট এয়ার, নভো এয়ার ও ইউএস বাংলা এয়ারের বিমানে সরাসরি যেতে পারেন কক্সবাজার।
হোটেল
কক্সবাজারে থাকার জন্য প্রচুর হোটেল রয়েছে। ধরণ অনুযায়ী এ সব হোটেলের প্রতি দিনের কক্ষ ভাড়া ৩শ’ থেকে ২৫ হাজার টাকা। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হোটেল হল-
হোটেল সী গাল, ফোন- ০৩৪১ ৬২৪৮০-৯১। হোটেল ওশান প্যারাডাইস, ফোন ০৩৪১ ৫২৩৭০। হোটেল লং বিচ, ফোন ০৩৪১ ৫১৮৪৩-৬। এ তিনটিই পাঁচ তারকা মানের হোটেল। 
এছাড়াও কক্সবাজারের অন্যান্য ভালো মানের হোটেল হল: হোটেল সি প্যালেস, ফোন- ০৪৩১ ৬৩৬৯২। হোটেল কল্লোল, ফোন- ০৪৩১ ৬৪৭৪৮। হোটেল কোরাল রিফ, ফোন- ০৩৪১ ৬৪৭৪৪-৫। নিটল বে রিসোর্ট, ফোন- ০৩৪১ ৬৪২৭৮। ইউনি রিসোর্ট, ফোন- ০৩৪১ ৬৩১৮১।
হোটেল সিলভার সাইন, ফোন- ০৩৪১ ৬৪৮৯৩-৪। হোটেল মিডিয়া ইন্টারন্যাশনাল, ফোন- ০৩৪১ ৬২৮৮১-৫। ডমিনাস রিসোর্ট, ফোন- ০৩৪১ ৫২২০২-৫। হোটেল ডায়নামিক সি পার্ল, ফোন- ০৩৪১ ৫২২৪৮-৯। হোটেল অভিসার, ফোন- ০৩৪১ ৬৩০৬১।
এছাড়া কক্সবাজারে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের রয়েছে হোটেল শৈবাল, ফোন- ০৩৪১ ৬৩২৭৪। মোটেল উপল, ফোন- ০৩৪১ ৬৪২৫৮। মোটেল প্রবাল, ফোন- ০৩৪১ ৬৩২১১। মোটেল লাবনী, ফোন- ০৩৪১ ৬৪৭০৩। পর্যটন করপোরেশনের ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকেও এসব হোটেলের বুকিং দেওয়া যায়, ফোন- ৯৮৯৯২৮৮-৯১।

ধন্যবাদ।